ভাষা প্রিয় মানুষের মিছিলে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো একুশ পাড়ায় পাড়ায় শহীদ মিনার গড়েছে শিশুরা
উম্মুল ওয়ারা সুইটি: একুশ মানে মাথানত না করা, একুশ মানে একটি জাতির ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। এই মর্মবাণী বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে এখন বিশ্বলয়ে। প্রতিবছরের মতো এবারও শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সর্বস্তরের মানুষ শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস পালন করেছেন।
তবে এবারের একুশ উদযাপনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে, পাড়ায় পাড়ায় শিশুদের নির্মিত শহীদ মিনার। শহীদবাগ, মগবাজার, খিলগাঁও, শুক্রাবাদ মিরপুর, আগারগাঁও, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় শহীদ মিনার তৈরি করেছে শিশু-কিশোররা। কাঁদা মাটি, ইট, কাঠ কিংবা বাঁশের তৈরি এসব শহীদ মিনারের বেদিতে শিশুদের সঙ্গে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের মিছিলে শরীক হয়েছেন, অভিভাবক ও স্থানীয়রা।
গতকাল রাতে সরেজমিন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উল্টোদিকে মূল সড়কেই দেখা গেছে, আশপাশের মানুষের ভিড়। সবাই দলে দলে রাস্তায় সারি বেধে ফুলি দিয়ে নিজেদের শিশু-কিশোরদের হাতে বানানো শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। এসব মিনারে বাজানো হয়েছে দেশাত্মবোধক গান। আবার কোথাও চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দেয়ালিকা ও চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর জাতির পক্ষ থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসা অতিথিদের স্বাগত জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের পক্ষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে সিনেট, সিন্ডিকেট সদস্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের বিভিন্ন প্রতিনিধিরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিসহ অন্য সমিতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে প্রভোস্টের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা শহীদ বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
এরপরে প্রধান বিচারপতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশ জুড়িশিয়াল সার্ভিস কমিশন, একুশে ল ইয়ার্স কাউন্সিল, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট, বাসদ (মার্কসবাদী), ছায়ানট, খেলাঘর, ইসলামী ব্যাংক, আনসারসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। আওয়ামী লীগের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এসময় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ এমপি, মোজাম্মেল বাবু এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম প্রমুখ।
এদিকে বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিদেশিদের পরিবেশনায় শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা পর্যায়ের শহীদ মিনারগুলোতে সরকারের উদ্যোগে নেওয়া হয়, নানা আয়োজন। ছিল বেসরকারি উদ্যোগও। রাজধানীতে জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনটা ছিল বিশাল। পুষ্পস্তবক অর্পণের পরপরই শোকের আবহ ভিন্ন রূপ নেয়। শহীদ মিনার ও এর আশপাশের এলাকা পরিণত হয় উৎসবের পীঠস্থান হিসেবে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বইমেলা প্রাঙ্গণে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। কোলের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সব বয়সী মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শহীদ মিনারে এসেছেন শ্রদ্ধা নিবেদনে। এরপর চারপাশে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষার আনন্দ উদযাপন করছেন। কেউবা এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কেউ বা ব্যস্ত গল্প করতে।
১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বুকের রক্ত দিয়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকত, শফিউর, জব্বারসহ অনেকে। তাদের রক্তে মায়ের ভাষা ফিরে পেয়েছে বাঙালি জাতি। এখন বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃত। তাই ২১ মানে শোক এবং একুশ হলো গৌরব।