হারিয়ে যাচ্ছে সিলেটের ‘রুঙ্গা-চাই’
আশরাফ চৌধুরী রাজু, সিলেট : হারিয়ে যাচ্ছে সিলেটে দেশী প্রযুক্তিতে মাছ ধরার সরঞ্জামগুলো। নগরায়নের ফলে এসব প্রযুক্তি এখন আর বেশি চোখে পড়ে না। অথচ এক সময় এ এগুলোর কদর সিলেট অঞ্চলে ছিল বেশি। হাওর, নদী-নালা ও খাল-বিলের অপূর্ব সমাহার রয়েছে। এ কারণে শুকনো মৌসুম শুরু হলেই গ্রামে গ্রামে শুরু হতো ‘রুঙ্গা’, ‘চাঁই’ তৈরির ধুম পড়তো। আর ক্ষেতের জমি, বিলে, খালে গ্রামের লোকজনই এসব জিনিস দিয়ে মাছ ধরতেন। কখনো কখনো গ্রামের লোকজন দলবেঁধে মাছ ধরতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচেছ দেশীয় প্রযুক্তির এ সরঞ্জামগুলো। ‘রুঙ্গা’, গুই ও চাঁই বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। অঞ্চল ভেদে এগুলোকে বিভিন্ন নামেও ডাকা হয়। যেমন ‘রুঙ্গা’, ‘কুকি’, ‘গুই’, ‘চাঁই’, ‘বাইর’, ‘বাঘা’, ‘মুছনা’, ‘ঘুনি’, ‘দারকি’ ও ‘দিয়াইর’। বাঁশ দিয়ে তৈরি প্রতিটি ফাঁদে থাকে বিভিন্ন আকৃতির খোপ। এসব খোপে সহজে মাছ প্রবেশ করতে পারে কিন্তু আর বের হতে পারেনা। ভাদ্র-আশি^ন মাস। নদী, হাওর, বিল-ঝিলের পানিতে ভাটার টান পড়ে হাওরাঞ্চলে। অথৈ জলের নীচে ডুবে থাকা জমির পানি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এসময় পানির টানের সাথে শুরু হয় মাছ ধরার মিছিল। পানির সাথে প্রতিযোগিতা করে নামতে না পেরে সমতল জমিনে সামান্য পানিতে আটকে থাকে প্রচুর মাছ। ‘নল’-‘খাগড়া’ আর জলজ উদ্ভিদের আড়ালে লুকিয়ে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ। খুব সহজেই এসব মাছ ধরা যায়। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে সিলেটের হাওরাঞ্চলে মাছ ধরার একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো স্থানীয় ভাষায় ‘ডাক বান্ধা’। আর ‘ডাক বান্ধা’ পদ্ধতির মাধ্যমে মাছ ধরার যন্ত্র হলো সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় ‘রুঙ্গা’ বা ‘কুকি’। বাঁশের বেত দিয়ে ‘রুঙ্গা’ তৈরী করা হয়। লম্বা গোলাকৃতির এই যন্ত্রটির সামনের অংশ থাকে সরু এবং পেছনের অংশ থাকে অপেক্ষাকৃত চওড়া। পানির টানে পেছনের অংশে গিয়ে মাছ আটকা পড়ে। ‘রুঙ্গা’র উচ্চতা ১ থেকে ২ ফুট। পেছনের চওড়া অংশ দিয়ে থাকে মাছ প্রবেশের ছোট পথ। যা দিয়ে মাছ প্রবেশ করতে পারলেও বেরোনোর কোনো উপায় থাকেনা। ‘রুঙ্গা’র সরু অংশের মুখ লতা-পাতা দিয়ে বন্ধ করে রেখে মাছ আটকাতে হয়। হাওরাঞ্চলের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়, ভাদ্র-আশ্বিন মাসে যখন হাওরের পানিতে টান পড়ে, তখন জমির পানি কমতে থাকে। এসময় পুঁটি, টেংরা, গুতুম (পুঁইয়া), বাইন,ভ্যাদা (মেনি), কৈ, চেঙ (টাকি), চান্দু (চান্দা), চাটা (খালিশ)সহ বিভিন্নি প্রজাতির ছোট মাছ আটকে থাকে। যেসব জমিতে ১ থেকে ২ ফুট পানি থাকে, সেসব জমিতে রাতেরবেলা মাছ নীচ থেকে উঠে আসে। রাতের শেষ ভাগে জমির চারদিকের পানি সমান আইল (বাঁধ) কাঁদা মাটি দিয়ে উঁচু করে বাঁধা হয়। ‘রুঙ্গা’র মুখ লতাপাতা দিয়ে বন্ধ করে বাঁধের কয়েক স্থানে পুঁতে রাখা হয়। বাঁধের কারণে জমির পানি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পুঁতে রাখার ‘রুঙ্গা’-এর ভেতর দিয়ে বের হয়। এসময় হালকা ¯্রােতের ধারা সৃষ্টি হয়। স্রোতের টানে বের হয়ে যাওয়া মাছ এসে ‘রুঙ্গা’র ভেতর আটকা পড়ে। দুই-তিন ঘন্টা পর পর এক-একটি ‘রুঙ্গা’ তুললে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। তবে মাছের সঙ্গে ‘রুঙ্গা’য় কাঁকড়া, সাপ ও শামুক আটকা পড়ে। গুই বা চাঁই দিয়ে মাছ ধরার মওসুম হলো বর্ষাকাল। গুই ও চাঁই বাঁশের শলা দিয়ে তৈরি করা হয়। সম্পাদনা: মুরাদ হাসান