গাইবান্ধায় পুলিশের প্রেস ব্রিফিং এমপি লিটনের হত্যার পরিকল্পনাকারী ও অর্থ জোগানদাতা কাদের খান
১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর
রফিকুল ইসলাম, গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি: গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থ জোগানদাতা সুন্দরগঞ্জের জাপা (এ) সাবেক এমপি কর্নেল (অব.) ডা. আব্দুল কাদের খান। নিজ আসনে আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বাসনায় পথের কাঁটা সরাতে লিটনকে হত্যা করেন তিনি। গতকাল গাইবান্ধা পুলিশ সুপার কার্যালয় চত্বরে প্রেস ব্রিফিংয়ে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিআইজি জানান, পুলিশ ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে এক মাস ২০ দিনের তদন্ত শেষে ২১ ফেব্রুয়ারি চাঞ্চল্যকর এই লিটন হত্যাকা-ের রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে। এমপি লিটনকে সরিয়ে দিয়ে পুনরায় ওই আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার উচ্চাভিলাষ ও ক্ষমতার মোহেই সাবেক এমপি কাদের খান এক বছর আগে থেকেই এই হত্যাকা-ের পরিকল্পনা করে। এজন্য তিনি তার ঘনিষ্ঠ ৪ সহচর মেহেদী হাসান, শাহীন, হান্নান ও রানাকে প্রলুব্ধ করে এবং নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে তাদের ৬ মাসব্যাপী নানাভাবে প্রশিক্ষণ দেন। তার ছক অনুযায়ী ইতোপূর্বে ঢাকা থেকে গাইবান্ধা আসার পথে এমপি লিটনকে গত অক্টোবর মাসে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাস্তায় প্রথমে তার গাড়িতে পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এতে গাড়ি থামিয়ে লিটন বের হয়ে আসা মাত্রই তাকে গুলি করে হত্যার পরিকল্পনা করে ওই কিলাররা। কিন্তু সে মিশনও ব্যর্থ হয়।
সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এমপি লিটনের নিজ বাড়িতে তাকে গুলি করে হত্যা করতে সক্ষম হয়। লিটন হত্যা মিশনে ৩ জন হত্যাকারী অংশ নেয়। তারা হলো- মেহেদী হাসান, শাহীন ও হান্নান। এরমধ্যে ৫ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে হত্যা নিশ্চিত করে মেহেদী হাসান। প্রথমে ৩ খুনি লিটনের সাথে জরুরি কথা আছে বলেই তার ঘরে ঢোকে। সেখানে ঢুকেই তাকে সালাম দিয়েই ১ রাউন্ড গুলি ছোড়ে মেহেদী। যা লিটন হাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে। ফলে সে গুলিটি হাতে লাগে। যেহেতু এই খুনিরা পেশাদার কিলার ছিল না, সেজন্য প্রথম গুলিটি ব্যর্থ হলে খুনি মেহেদী ঘাবড়ে যায় এবং চোখ বন্ধ করে এলোপাতাড়ি পরবর্তী ৪ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে হত্যা নিশ্চিত করে। হত্যাকা- শেষে তাদের ব্যবহৃত ডাইং ব্রাউন্সার রানার ১০০ সিসির কালো রংয়ের মোটরসাইকেলটিতে চড়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। খুনে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি কাদের খানের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত এবং রেজিঃ বাবদ প্রদত্ত ফি জমা করা হয়েছে এমডি আলী নামে। যা পুলিশ জব্দ করেছে। এরপর রাস্তায় অপেক্ষমাণ কাদের খানের গাড়িতে কিলাররা বগুড়ায় তার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে পরে খুনিরা বাসে ঢাকায় গিয়ে কাদের খানের সহযোগিতায় আত্মগোপন করে থাকে।
এমপি লিটনের কিলাররা গত ২ জানুয়ারি গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়কে ধোপাডাঙ্গায় হত্যাকা-ে ব্যবহৃত ওই পিস্তলটি ব্যবহার করে ভয় দেখিয়ে ফাইম নামে এক যুবকের কাছ থেকে তার মোবাইল ও টাকা পয়সা ছিনতাই করে। ছিনতাই শেষে তাড়াহুড়া করে পালাতে গিয়ে পিস্তলের ৬ রাউন্ড বুলেটের ম্যাগাজিনটি তাদের অগোচরে রাস্তায় পড়ে যায়। যা স্থানীয় জনগণের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পুলিশ উদ্ধার করে। এই পিস্তলের বুলেট পরীক্ষা করে দেখা যায় এমপি লিটনের শরীর থেকে অপারেশন করে বের করা এবং তার বাড়িতে হত্যার পর প্রাপ্ত বুলেটের খোসার সাথে ওই ম্যাগাজিনের বুলেটের মিল রয়েছে। পরে এই সূত্র ধরে খুনিদের আটক করা হয় এবং পিস্তলটির ব্যালাস্টিক পরীক্ষার জন্য ঢাকায় প্রেরণ করা হয়।
গ্রেফতারকৃত ৩ খুনি মঙ্গলবার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে খুনের ঘটনা স্বীকার করে এবং এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী, অর্থ জোগানদাতা ও প্রশিক্ষণদাতা হিসেবেও আব্দুল কাদের খানের নাম উল্লেখ করে। এদিকে খুনিরা কাদের খানের পিস্তলটি ব্যবহার করেছিল বলেই বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। তবে ঢাকা থেকে প্রাপ্ত ব্যালাস্টিক পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার পর তারা চূড়ান্ত হবেন বলে ধারণা করছেন। এদিকে সুন্দরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মুহাম্মদ আতিয়ার রহমান খুনিদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক কাদের খানের পিস্তল এবং বুলেট জব্দ করে। কিন্তু ৪০ রাউন্ড বুলেট ক্রয় করলেও কাদের খান পুলিশকে মাত্র ১০ রাউন্ড বুলেট জমা দিতে সক্ষম হয়েছে। বাকি ৩০ রাউন্ড বুলেটের হিসাব সে দিতে পারেনি।
পুলিশ কর্তৃক লিটনের হত্যার পরিকল্পনাকারী ও খুনিদের গ্রেফতার করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী লিটনের বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকলী। তিনি এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এই খুনের রহস্য উদঘাটনে নিয়োজিত পুলিশ ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানান এবং খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। লিটনের স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতিও অনুরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
বুধবার দুপুরে পুলিশ কাদের খানকে গাইবান্ধার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে। শুনানি শেষে আদালত ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালতের বিচারক মইনুল হাসান ইউসুফ।
জেলা জজ আদালতে সরকার পক্ষের পিপি অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম শফি বলেন, চাঞ্চল্যকর এমপি লিটন খুনের মামলাটি জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী দ্রুত বিচারের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সে কারণে এই মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সম্পাদনা: এনামুল হক