পাকিস্তানি লেখক ড. জুনায়েদ আহমদের বইতে প্রকাশ মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ নিহত, ২ লাখ নারী নির্যাতিত এই দাবি জিয়া, এরশাদ, খালেদার সরকার করেনি, আ. লীগ করে
সীমা কায়সার: পাকিস্তানি শিক্ষাবিদ ডক্টর জুনায়েদ আহমদ একটি বই লিখেছেন ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ: মিথস এক্সপ্লোডেড’ বইটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানি দৃষ্টিভঙ্গি এবং পাকিস্তানি স্বার্থে প্রচুর বিভ্রান্তি এবং বিতর্কের অবতারণা করা হয়েছে।
ডক্টর জুনায়েদ এখন এই বইয়ের বিষয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য পাঁচটি নিবন্ধ লেখার ঘোষণা দিয়েছেন এবং এর প্রথমটি ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রথম নিবন্ধটি বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ হত্যাকা-ের হিসাবকে নানান তথ্য, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে নাকচ করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই বই এবং লেখাগুলো আমাদের পড়তে হবে এবং এর সমুচিত জবাবও দিতে হবে।
ডক্টর জুনায়েদ আহমদ তার নিবন্ধে জোরালোভাবে উল্লেখ করেছেন যে, জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল হুসেইন মুহাম্মাদ এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা হয়েছে এবং এ সময়ে ৩০ লাখ মানুষ নিহত হওয়া এবং দুই লাখ নারী নির্যাতিত হওয়ার দাবি করা হতো না কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার জোরালোভাবে এই দাবি করছে।
তার নিবন্ধ অনুসারে, ৩০ লাখ মানুষের হত্যাযজ্ঞের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় বিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারি মুখপত্র ‘প্রাভদা’ এর ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর সংখ্যায় প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয়তে।
ডক্টর জুনায়েদের দাবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাভদার এই রচনার ভিত্তিতেই ১৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বিবিসির সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের সাথে সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন যে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন।
বিবিসি বাংলা সার্ভিসে এক সময়ের উপ-প্রধান সেরাজুর রহমানের ২৪ মে ২০১১ তারিখে ‘দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায়’ প্রকাশিত এক চিঠিতে দাবি করেছিলেন যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ৩ মিলিয়ন (অর্থাৎ ৩০ লাখ) নিহতের সংখ্যাটি ‘ভুলবশত’ বলেছেন এবং বঙ্গবন্ধু সম্ভবত ৩ লাখ নিহতের কথা বলতে চেয়েছিলেন। কারণ সেরাজুর রহমানের মতে, বিভিন্ন সূত্রে ১৯৭১ সালে নিহতের যে হিসেব পাওয়া যায় সেগুলো যোগ করলে ৩ লাখের বেশি হয় না।
ডক্টর জুনায়েদ তারপর নির্ভর করেছেন সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের একটি লেখার ওপর। ডেভিড বার্গম্যান ২০১১ সালে লিখেছিলেন যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব সাইয়িদ করিম এর মতে, বঙ্গবন্ধু যে ডেভিড ফ্রস্টের কাছে ৩০ লাখ মানুষের নিহতের দাবি করেছেন সেটা ভীষণরকম বাড়িয়ে বলা হয়েছে।
ডক্টর জুনায়েদ আহমদ তারপর আরও দাবি করেছেন যে ২৯ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি অনুসন্ধানে একটি কমিশন গঠন করেছিলেন। যারা ৭১ এর যুদ্ধে মাত্র ৫৬ হাজার ৭৪৩টি হত্যাকা-ের তথ্য পেয়েছিল এবং তখন বঙ্গবন্ধু এর জন্য কমিশনের উপর খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এই তথ্যগুলো ডক্টর জুনায়েদ নিয়েছেন জনৈক চৌধুরী আবদুল মুমিন রচিত ‘বিহাইন্ড দ্য মিথস অব থ্রি মিলিয়ন’ থেকে। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে।
ডক্টর জুনায়েদ উল্লেখ করেছেন, নরওয়ের পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট ১৯৭১ সালে অনুসন্ধান করে পেয়েছিল যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মারা গিয়েছেন মোটামুটি ৫৮ হাজার মানুষ।
এলএ টাইমস পত্রিকায় ১৯৭২ সালের জুন মাসে সাংবাদিক উইলিয়াম ডার্মনন্ড লিখেছিলেন যে, ৩০ লাখ নিহতের হিসাব অসম্ভব ও অবাস্তব। ২৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়নি। জুনায়েদ আরও উল্লেখ করেছেন যে, সুইডিস সাংবাদিক ইংভান ওজা তার পত্রিকা ডাজেশন নাইহিটার এ লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়নি। ৩০ লাখের সংখ্যাটি অতি বাড়াবাড়ি। ডক্টর জুনায়েদ তারপর উল্লেখ করেছেন ভারতীয় বাঙালি লেখক ও গবেষক শর্মিলা বসুর লেখা এবং ২০১১ সালে প্রকাশিত বই ডেড রিকোনিং এ উল্লেখিত মন্তব্য, ৩০ লাখ সংখ্যাটি গুজব। মৃত্যুর সংখ্যা হবে ৫০ হাজার থেকে এক লাখের মধ্যে এবং এর ভেতর নিহত বাঙালি, বিহারী এবং পশ্চিম পাকিস্তানিরা সকলেই অন্তর্ভুক্ত।
জনৈক বাংলাদেশি লেখক সাংবাদিক মোহাম্মদ তাজেমূল হোসাইন মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষ নিহত এবং দুই লাখ নারী নির্যাতিত হওয়ার খবরকে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট বলে অভিহিত করেছিলেন বলে লিখেছেন এমনটা, ডক্টর জুনায়েদ দাবি করেছেন।
ডক্টর জুনায়েদ তার লেখায় উল্লেখ করেছেন যে ১৯৭২ সালের শুরুতে ব্রিটেনের একটি চিকিৎসক দল বাংলাদেশে গর্ভপাত ঘটনার মতো মাত্র শতাধিক গর্ভবতীকে পেয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার একজন গবেষক ও বিশ্লেষক বিন ডি কস্তা ১৯৭১ সালে দুই লাখ নারী ধর্ষিতা হওয়ার সংখ্যা সঠিক নয় বলে বলেছিলেন।
ডক্টর জুনায়েদ আহমদ এই নিবন্ধের শেষ দিকে একটি সংখ্যাতাত্ত্বিক যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৬০ লাখ ইহুদি ৬ বছর সময়ের মধ্যে হত্যা করতে গড়ে প্রতিদিন ২ হাজার ৭৪০ জনকে মারতে হয়েছে এবং ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৬২ দিনে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করতে প্রতিদিন গড়ে অবশ্যই ১১ হাজার ৪৫০ জনকে মারতে হয়েছে। এই বলে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন এটা সম্ভব কি না।