পেশা বদল করছেন মুন্সীগঞ্জের পাটি কারিগররা
নাদিম মাহমুদ,মুন্সীগঞ্জ: মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার পাইকপাড়া বা পাটিকরপাড়া এলাকার পাটির বেশ সুনাম রয়েছে। প্রায় ৪০০ বছরের ঐতিহ্য এই পাটি শিল্প। পাটিকরপাড়া এলাকায় নারী-পুরুষ মিলে প্রায় শতাধিক পরিবার পাটি তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এছাড়াও সিরাজদিখানের বাটিনভোগ ও টঙ্গীবাড়ী উপজেলার কামারখাড়ায় আরো কিছু নারী-পুরুষ পাটি শিল্প তৈরির কাজে যুক্ত রয়েছেন। মোতরা নামক গাছের বাকল দিয়ে তৈরি হয় পাটি। পাটি তৈরির কাঁচামাল মোতরা স্থানীয়ভাবে উৎপাদন না হওয়ার কারণে সিলেটের গোয়াইনঘাট থেকে আনতে হয় চড়ামূল্যে। পাটির চাহিদা থাকলেও দিন দিন উৎপাদন কমে যাওয়ায় মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্য আজ হারাবার পথে।
স্থানীয়ভাবে পাটির কাঁচামাল না পাওয়া যাওয়ার কারণে উচ্চমূল্যে মোতরা সিলেট থেকে আনতে হয়। গত বছর আগে এক পাটির মোতরা ৫৫ টাকায় পাওয়া যেত। এখন কিনতে হয় ৭০ টাকায়। সিলেটের গোয়াইনঘাটের মাত্র ২ জন মহাজন রয়েছেন। তারা বাগান থেকে মোতরা সংগ্রহ করেন। ওই ২ মহাজনের কাছ থেকে বাধ্য হয়ে মোতরা চড়াদামে কিনতে হয়। মোতরা থেকে বেতি ও আতি তৈরি হয়। বেতি দিয়ে পাটি তৈরি হয়। এবং আতি পান ও শাক-সবজি বাঁধাইয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া মোতরা সংগ্রহ করতে মুন্সীগঞ্জের পাটি তৈরির কারিগররা অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন এই ৪ মাস সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থান করেন। পুরুষরা মোতরা থেকে বেতি কেটে দেন এবং বেতি শুকানোর পর নারীরাই পাটি তৈরি করে থাকেন। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মুন্সীগঞ্জের পাটিকরপাড়ার নারীরা পাটি তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকেন। এ ক্ষেত্রে তাদের স্কুল-কলেজে পড়–য়া সন্তাানরাও ফাঁকে ফাঁকে পাটি তৈরি করে থাকেন। বর্তমানে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাওয়া ও অলাভজনক ব্যবসা হওয়ায় অনেক কারিগরই এ শিল্পে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। পাটি তৈরির নারী শ্রমিকরা জানান, তাদের একটি পাটির বাইন তৈরি করতে সময় লাগে ২ থেকে ৩ দিন। এতে একটি দেশি অর্থাৎ মোটা পাটির বাইন তৈরিতে মজুরি পান ১১০ টাকা, সিলেটের একটি পাটির বাইন তৈরি বাবদ ১৫০ টাকা ও চিকন বাইন তৈরিতে ৫শ’ থেকে ৭শ’ টাকা মজুরি পায়। চিকন পাটির বাইন তৈরিতে ১০-১২ দিনও সময় লাগে বলে নারী শ্রমিকরা জানালেন। এতো কম মজুরি অন্য কোনো পেশায় নেই বলে শ্রমিকদের অভিযোগ। এসব কারণে তারা এখন নানামুখী পেশায় চলে গেছে, কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ স্বর্ণের কাজ, কেউ ওয়ার্কশপ কেউবা আবার বিদেশে চলে যাচ্ছে। তারপরও মুন্সীগঞ্জের পাটিকরপাড়ায় শতাধিক পরিবারের প্রায় ৩শ’ সদস্য বাপ-দাদার এ পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করছেন। এদিকে, শীতল পাটি ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায়, চিকন পাটি ১ হাজার ৭শ’ থেকে ১ হাজার ৮শ’ টাকায় এবং মোটা পাটি ৪৫০ টাকা থেকে ৫শ’ টাকায় পাইকারি বিক্রি করছেন। কিন্তু এতে তাদের তেমন লাভ হচ্ছে না বলে পাটি তৈরির কারিগররা জানালেন।
পাটিকরপাড়া গ্রামারে বধূ সবিতা মুদি। বাইশ বছর আগে তার বিয়ে হয়েছে। টঙ্গীবাড়ীর বাইগ্যা গ্রামের বাবা আনন্দময় চন্দ্র দেও এ পেশার সঙ্গে জড়িত। স্বামী মদন মোহন মুদি ও সন্তানকে নিয়ে সবিতা পাটি বুনছেন স্বামীর বাড়িতে। তিনি ঢাকার শাহবাগ জাদুঘর (জাতীয় জাদুঘর), বাংলা একাডেমি ও সোনারগাঁয়ে কারুশিল্প মেলায় প্রতিবছরই অংশগ্রহণ করছেন। গত বছরের ১৬ই নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে শ্রীলঙ্কায় কারুশিল্প মেলায় অংশ নিয়ে এক সপ্তাহ পর দেশে ফিরেন। পাটি তৈরির মোতরা সংগ্রহ ও তা থেকে বেতি তৈরি করার পুরুষ কারিগররা জানালেন, পাটি বুনা তারা বংশ পরম্পরায় করে আসছেন। এটা তাদের বাপ-দাদার পেশা। এ পেশায় রুজি-রোজগার কমে যাওয়ায় তারা এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। পাটি তৈরির মোতরার দামও বেড়ে গেছে। তারা দিনদিন নি.স্ব হয়ে যাচ্ছেন। আগে যেমন তাল পাখা আর শীতল পাটির কদর ছিল-এখন আর তার সমাদর নেই। সরকারি সহযোগিতার মাধ্যমে তারা কাঁচামাল পেলে তাদের জন্য পাটি তৈরি লাভজনক হতো। মুন্সীগঞ্জ বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক মো. সাইফুল আলম জানিয়েছেন, পাটিকরপাড়ার ২ জন পাটি শিল্পের উদ্যোক্তাকে আমরা দেড়লাখ টাকা ঋণ দিয়েছি। যাদের জমি ও বাড়িঘরের কাগজপত্র আছে তাদের আমরা অগ্রাধিকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ দিয়ে থাকি।পাটি শ্রমিকরা মনে করেন। সম্পাদনা : মুরাদ হাসান