কানাডায় ফেডারেল কোর্টের বিচারক নয় শরণার্থীই বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসী দল’ বানিয়েছে
মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে
কানাডায় স্থায়ী অভিবাসন বা ‘পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি’র ক্ষেত্রে বিএনপির অঙ্গসংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের কথিত কর্মী মোহাম্মদ জুয়েল হোসেন গাজীর আবেদনটি নাকচ করে দিয়েছেন ফেডারেল কোর্টের বিচারক হেনরি এস ব্রাউন। আইএমএম-২৪০১-১৬ নথিভুক্ত ওই রায়টি চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি দেওয়া হলেও রিভিউ শুনানি হয় টরন্টো কোর্টে ১১ জানুয়ারি। তাতে পরিশেষে বিচারক প্রদত্ত দুই লাইনের নাকচ রায়ে কোথাও বিএনপিকে সরাসরি ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ অভিহিত করে রায় না দিলেও আবেদনকারীই বিএনপিকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পরিপূরণে সশস্ত্র সংগ্রাম ও সহিংসতা করে থাকে’ বলে মতামত দেন। এমনকী বলেন, বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি ‘অস্ত্রেশস্ত্রে যুদ্ধংদেহী হয়। তারা হাত বোমা, পিস্তল ও বড় তরবারি ব্যবহার করে। তারা হরতাল বা মিছিল চলাকালীন সরকার পক্ষের লোকদের উপর আক্রমণ করে’। ফলশ্রুতিতে কানাডায় অভিবাসন ও শরণার্থী আশ্রয় আইনের ‘সদস্যপদ’ ও ‘সন্ত্রাসে সম্পৃক্ত’ থাকার পৃথক দুটি ধারায় ২০১৬ সালের ১৬ মে উচ্চ অভিবাসন কর্মকর্তা প্রদত্ত তার ‘অগ্রহণযোগ্য’ সিদ্ধান্তটিকেই বহাল রেখেছেন।
ওই রায়ের ৩৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ বিবরণীতে প্রকাশ, বাংলাদেশের নাগরিক মোহাম্মদ জুয়েল হোসেন গাজী ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি কানাডায় আসেন। সেদিনই শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়ের আবেদন করেন।
ওই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর তাকে আইনগতভাবে শরণার্থী চিহ্নিত করা হয়। ২০১৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি স্থায়ী অভিবাসনের আবেদন করেন। পরের বছর ২৮ এপ্রিল প্রথম ধাপের অনুমোদন পান। দ্বিতীয় ধাপে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার আবেদন দীর্ঘায়িত হয় এবং পর্যায়ক্রমিক আইনগতভাবে ‘অগ্রহণযোগ্য’ হয়ে পড়ে। আবেদনকারী কয়েক দফায় বিএনপির সদস্যপদের বিষয়টি উল্লেখ করেন। তার ‘বিওসি’ বা বেসিস অব ক্লেইম বা দাবির ভিত্তির বর্ণনায় রয়েছেÑ ১৯৯৭ সালের মাঝামাঝি ঢাকায় একটি কলেজে পড়াকালীন বিক্ষোভ, সেমিনার ও সভা জাতীয় রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশ নেন। ২০০৪ সালে পড়াশুনা করতে কোরিয়া যান এবং বাংলাদেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ফিরে আসেন। ২০০৫ সালে তিনি জাপানে যান এবং দেশের ‘পরিস্থিতি অবলোকন’ করতে থাকেন। তার ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে গ্রেফতারপূর্বক ২০০৮ সালে বাংলাদেশে বিতাড়িত হন। ওই বছরের শেষে মিরপুর বিএনপির অধীন স্বেচ্ছাসেবক দলে যোগ দিয়ে পরবর্তী কয়েকটি নির্বাচনি প্রচারণা চালান। তিনি রাজনৈতিক দলেরও সদস্য ছিলেন। তার ভাষায়, ‘আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অপরাপর বৃহৎ রাজনৈতিক দলের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা তাকে বিএনপির আত্মনিবেদিত কর্মী হিসেবে চিনতেন এবং দলের সঙ্গে তার সৎ, হৃদয়সোপিত ও নিবেদিত সংশ্লিষ্টতা ছিল’।
একইসঙ্গে স্বীকার করেন বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণের ক্ষেত্রে তা ছিল মনস্থিরপূর্ণ, সেক্ষেত্রে বিএনপিতে কোনো ইস্যুই তৈরি হয়নি, বরং তা প্রদান করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর অভিবাসনের অগ্রহণযোগ্যতার ৩৪(১) ধারায় ‘কানাডা বর্ডার সিকিউরিটি এজেন্সি’র জাতীয় নিরাপত্তা বাছাই বিভাগ বিএনপির কার্যক্রমের উপর তার বর্ণিত মতামতের ভিত্তিতে মূল্যায়ন সম্পন্ন করে, যেখানে বর্ণিত হয়েছে: বিএনপি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পরিপূরণে সশস্ত্র সংগ্রাম ও সহিংসতা করে থাকে’। এছাড়া বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি ‘অস্ত্রেশস্ত্রে যুদ্ধংদেহী হয়। তারা হাত বোমা, পিস্তল ও বড় তরবারি ব্যবহার করে। তারা হরতাল বা মিছিল চলাকালীন সরকার পক্ষের লোকদের উপর আক্রমন করে’। আরো ছিল যে, হরতাল চলাকালীন বাড়িঘর থেকে কেউ বের হয়নি, অফিসপাড়া বন্ধ ছিল, কোনো যানবাহন চলেনি এবং রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা ছিল। এগুলোই বিরোধী দলের কর্মকা- ছিল। এ বিষয়গুলোই তার অভিবাসন আবেদন ‘আইএমএম ৫৬৬৯’ বর্ণিত রয়েছে।
এতে অভিবাসন কর্মকর্তা ফৌজদারী ধারা মতে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী সংজ্ঞায় সন্ত্রাসী দল ব্যাখ্যায় অভিমত রাখেনÑ যদিও বিএনপির জন্য আবেদনকারীর ব্যক্তিগত সন্ত্রাসী ভূমিকা যৎসামান্য; তথাপি সরকারকে বাধ্য করাতে বিএনপির লাগাতার হরতাল নির্ভরশীলতা অর্থনীতি ব্যাহত করার পাশাপাশি হরতালের ফলে সহিংসতা সৃষ্টিতে বিএনপি সদস্যরা যা করেছে, তা বিএনপির সন্ত্রাসী কর্ম হিসেবে বিবেচ্য। এক্ষেত্রে আবেদনকারীর জন্য অভিবাসন কর্মকর্তার ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় দ্বিধাহীনভাবে বিএনপির কর্মকা- সন্ত্রাসমূলক কি না। সেক্ষেত্রে মানসম্মত বিবেচনায় সুপ্রিম কোর্ট অব কানাডায় ২০০৮ সালে পরিচালিত ‘ডানসম্যূর বনাম নিউ ব্রন্সউইক’ মামলার ৪৭, ৫৭, ৬২ অনুচ্ছেদ এবং ‘গুতিয়ারেজ বনাম কানাডা’ মামলার ২১ অনুচ্ছেদসহ অপরাপর আইনি ব্যাখ্যায় বিচারক সদাশয় বিবেচনায় অভিবাসন কর্মকর্তার অভিমতের ভিত্তিতে রায়ে মতামত রাখেনÑ সন্ত্রাসে ‘বিএনপি যুক্ত ছিল, রয়েছে ও হবে’, যা কানাডার আইনের বিশদ ব্যাখ্যায় সুস্পষ্ট। তারপরও ওই রায়ে বিচারক হেনরি এস ব্রাউন অভিবাসন কর্মকর্তার উদঘাটিত তথ্য এবং অনলাইনে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি টেরোরিস্ট অ্যাক্টস’ শিরোনামে আবিস্কৃত সংবাদ ও তথ্যের ভিত্তিতে মতামত রাখেনÑ বিএনপি ও আওয়ামী লীগ হচ্ছে বাংলাদেশে দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। আবেদনকারীর একজন কৌশলীর মতে বাংলাদেশের রাজনীতি সহিংস। আর সেই বিবেচনায় উভয় দলই অনুরূপ কৌশলে যুক্ত। অর্থাৎ ‘ইন দ্যাট রেসপেক্ট বোদ পার্টিজ হ্যাভ অ্যাঙ্গেজড ইন সিমিলার টেকটিকস’।
ই-মেইল: [email protected]