বিএনপির আন্দোলন তখন সত্যিই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে ধাবিত হয়েছিল
ড. বদরুল হাসান কচি
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করেছে কানাডার ফেডারেল আদালত। বিএনপির সদস্য হওয়ার কারণে একজন বাংলাদেশির রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন নাকচের বিরুদ্ধে করা জুডিশিয়াল রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করতে গিয়ে অভিবাসন কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত বহালের পাশাপাশি পর্যবেক্ষণে দলটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে মন্তব্য করেছেন ফেডারেল আদালতের বিচারক। রায়ে বিচারক বলেন, উপস্থাপিত তথ্যপ্রমাণাদি অত্যন্ত যতেœর সঙ্গে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের পর ‘বিএনপি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন’ এটি বিশ্বাস করার যৌক্তিক ভিত্তি আছে বলে আমি মনে করি।
অপরদিকে বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে পাল্টা অভিযোগ করে দায় তুলে দিলেন সরকারের কাঁধে; বলেছেন এই রায়ের পেছনে সরকারের ষড়যন্ত্র রয়েছে। সম্মেলনে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দাবি করেন, নির্বাচনের আগে জনগণের মধ্যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করতে এসব নাটক সাজাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে দেশের শীর্ষ একটি অনলাইন গণমাধ্যমের সংবাদে বলা হয়েছে, এ রায় দেওয়ার পর কানাডা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চিন্তা করছে বিএনপি। এরই মধ্যে দলটির দুজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এ নিয়ে ঢাকাস্থ কানাডিয়ান দূতাবাসে গিয়ে প্রাথমিক আলোচনাও করেছেন। খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া মোহাম্মদ জুয়েল হোসেন গাজীরও ব্যাপারে।
দেশের বাহিরে সুদূর কানাডার আদালতে এমন একটি রায়ের পেছনের কথা কৌতুহল-উদ্দীপক নাগরিকের জানার অধিকার রয়েছে; তাই প্রসঙ্গ টানা দরকার মনে করছিÑ মোহাম্মাদ জুয়েল হোসেন গাজী নামে ঢাকার মিরপুরের স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন কর্মীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন নাকচ হওয়ার পর তিনি ফেডারেল আদালতে জুডিশিয়াল রিভিউ আবেদন করেছিলেন। রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন গ্রহণ করে ২৮ এপ্রিল, ২০১৫ তাকে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে প্রথম পর্যায়ের অনুমোদন দেওয়া হলেও ২০১৬ সালের ১৬ মে তাকে কানাডায় প্রবেশের অযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিএনপির সদস্য হওয়ায় তাকে কানাডায় প্রবেশের অনুপযুক্ত ঘোষণা করে বলা হয়, বিএনপি সন্ত্রাসী কাজে জড়িত ছিল, আছে বা থাকবেÑ এটি বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ আছে। ফেডারেল আদালতের বিচারক হেনরি এস ব্রাউন গত ২৫ জানুয়ারি মামলাটির রায় ঘোষণা করেন। জুডিশিয়াল রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করতে গিয়ে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি, বিএনপির পরিচালিত লাগাতার হরতাল এবং হরতালকে কেন্দ্র করে পরিচালিত সন্ত্রাসী তৎপরতা সম্পর্কে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।
কানাডার আইনে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা বিস্তৃত। এটা শুধু কানাডা নয়, কানাডার বাইরের দেশের ক্ষেত্রেও বিবেচনায় নিয়ে থাকে আদালত। আইনে বলা হয়েছে, জনগণ বা জনগণের কোনো অংশকে ভীতি প্রদর্শনমূলক কর্মকা- যা অর্থনৈতিক নিরাপত্তাসহ (হরতাল) সার্বিক নিরাপত্তা বিঘিœত করে, যেসব কর্মকা-ে সহিংসতার কারণে হত্যা বা গুরুতর জখমের ঘটনা ঘটে, ব্যক্তিজীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, সম্পদের ক্ষতিসাধন হয় একইসঙ্গে জনগণের জন্য জরুরি সেবা ও সুবিধা ব্যাহত হয় সে সবই সন্ত্রাসী কর্মকা-।
এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট অভিবাসন কর্মকর্তা কানাডার ক্রিমিনাল কোডের ধারা তুলে ধরে বলেন, বিএনপির ডাকা হরতাল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বিএনপি কর্মীদের হাতে মালামালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও মৃত্যু এবং আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। আমি লক্ষ্য করেছি, অতীতে কোনো কোনো ঘটনায় বিএনপির নেতৃত্ব নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে এবং সন্ত্রাসী তৎপরতার নিন্দা করেছে। কিন্তু বিএনপির দাবি-দাওয়া সরকারকে মানতে বাধ্য করতে লাগাতার হরতালের কারণে সৃষ্ট সহিংসতা প্রমাণ করে, এটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের বাইরে চলে গেছে। জুডিশিয়াল রিভিউর নিষ্পত্তি করতে গিয়ে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক উল্লেখ করে বিচারক হেনরি এস ব্রাউন বলেন, কানাডার আইনে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের যে সংজ্ঞা দেওয়া আছে তার আলোকে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই ওই কর্মকর্তা উপসংহারে পৌঁছেছেন।
‘সন্ত্রাসী’ শব্দটির নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে বাংলাদেশে। তাই হয়তো রায়ে বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ অ্যাখ্যা দেওয়ায় বিএনপি সমর্থকরা সহজে মানতে পারছেন না বিষয়টি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের পর দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন ছিল তা কারও অজানা নয়; এই মামলার রায়ে সে সময়কার ঘটনাকেই টেনে আনা হয়েছে, অবশ্য সেটা ইচ্ছাকৃত নয়, যে ব্যক্তি মামলাটি করেছেন তিনি ওই ঘটনার ভুক্তভোগী হিসেবে মামলায় তুলে ধরেছেন। কে জানত যে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে গিয়ে উল্লেখ করা ঘটনাটি পুরো একটি দলকেই বেকাদায় ফেলে দিবে?
ওই নির্বাচনের পর বিএনপির টানা অবরোধ অমান্য করে রাস্তায় বের হওয়ায় প্রাণ দিতে হয়েছে প্রায় শতাধিক নিরীহ মানুষকে; সম্পদের হানি ঘটেছে প্রায় হাজার কোটি টাকার। তৎকালীন সময়ে দুঃসহ দিনগুলো ফুটে উঠেছে দেশ-বিদেশের উল্লেখযোগ্য সব মিডিয়াতে। একটি রাজনৈতিক দলের কাছে কোটি কোটি মানুষ কিভাবে অন্যায়ভাবে জিম্মি হয়েছিল তা বিশ্ববাসী দেখেছে। তাই বিএনপি সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিষয়টিকে সরকারের চক্রান্ত বলে এড়িয়ে যাবার যে দাবি তুলেছেন সেটি পুরোপুরি অমূলক। কারণ ওই দুঃসহ সময়টি নিকট অতীতের ঘটনা, এখনো সবার স্মৃতিতে স্পষ্ট। তাছাড়া কেবল ক্ষমতায় যাবার জন্য ওইসময় দলটি তারই ভোটারদের উপর যে আচরণ করেছে সেটি নির্দ্বিধায় সন্ত্রাসী কর্মকা-ই ছিল বটে; তা বুঝতে সাধারণ নাগরিকদের কানাডার আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় না, এটি সহজে অনুমেয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে ২০১৩ সালে পাসকৃত সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) আইনের ৬ ধারাতে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তার ব্যাখ্যা অনুযায়ীও আন্দোলনের নামে বিএনপির ওই জ্বালাও-পোড়াও কর্মকা-কে সম্পূর্ণভাবে একটি সন্ত্রাসী আচরণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
সম্পাদনা: আশিক রহমান