পূর্বপুরুষের পেশাকে ধরে রাখতে সংগ্রাম করছেন নওগাঁর মৃৎশিল্পীরা
আশরাফুল নয়ন, নওগাঁ : আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। অন্যদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মৃৎশিল্পকে ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে এ পেশার লোকজন। পূর্বপুরুষের এ পেশাকে ধরে রাখতে প্রতিনিয়ত চলছে সংগ্রাম। দইয়ের পাতিলই এখন যেন তাদের এক মাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার এনায়েতপুর পালপাড়া,রাণীনগর উপজেলার খট্টেশ্বর, আতাইকুলা, হরিশপুর, গহেলাপুর, আত্রাই উপজেলার রাইপুর, মিরাপুর, সাহেবগঞ্জ, বহলা, পাঁচুপুরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মৃৎশিল্পীদের বাসস্থান। এসব গ্রামে প্রায় আট থেকে দশ হাজার মৃৎশিল্পী মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন যুগের পর যুগ। এসব এলাকা থেকে তৈরি মৃৎশিল্পের মনকাড়া পণ্যগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে জায়গা করে নিয়েছিল একসময়। কিন্তু প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও বাজারের অভাবে এ শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। এক সময় হয়তো এ শিল্পের স্থান হবে জাদুঘরে। সে সময় আসতে হয়তো আর বেশি দিন নেই।
এক সময় বেশ কদর ছিল মাটির তৈরি জিনিসপত্রের। তবে সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে তা। বর্তমান সময়ে দস্তা, অ্যালুমিনিয়াম এবং প্লাস্টিক থেকে তৈরি জিনিসপত্রের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকিয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এ পেশার সঙ্গে জড়িতদের জীবন যাপন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। উপজেলার গ্রামগুলোতে এখন আর মাটির হাড়ি-পাতিল তেমন চোখে পড়ে না। এছাড়াও মৃৎশিল্প তৈরির উপকরণ মাটি সংকট, খড়ির দাম বেশি হওয়ায় দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদাও কমেছে।
মৃৎশিল্পে হাঁড়ি, পাতিল, ঢাকনা, কাসা, পেয়ালা, মাইসা, সাতখোলা, ব্যাংক, কলস, ডাবর, পানি রাখার পাত্র সহ প্রভূতি তৈরী করা হয়। বর্তমান বাজারে এগুলোর তেমন কদর নেই বললেই চলে । এগুলোর বিকল্প হিসেবে অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের অনেক টেকসই পণ্য বাজারে পাওয়া যাচ্ছে স্বল্প মূল্যে । তবে দইয়ের পাতিল অথ্যাৎ লোকাল ভাষায় যাকে বলা হয় দইয়ের ভাঁড় এর চাহিদা এখনও রয়েছে। কারণ দইয়ের পাতিল এর বিকল্প এখন তৈরি হয়নি । দুধ দিয়ে দই তৈরি করতে দুধের মধ্যকার অতিরিক্ত পানি মাটির পাতিল শোষণ করে জমাট বেঁধে দই তৈরি হয়। যা অ্যালুমিনিয়াম বা প্লাস্টিকের পাতিলে সম্ভব নয়। তাই এখনও চাহিদা রয়েছে দইয়ের পাতিলের। নওগাঁসহ জয়পুরহাট ও বগুড়া জেলা থেকে এসে পাইকারা নিয়ে যান মৃৎশিল্পের পণ্য । মাটির এসব জিনিসপত্র দিয়ে একটি ভাটা সাজাতে প্রায় ১মাস সময় লাগে।বদলগাছী উপজেলার এনায়েতপুর পালপাড়া গ্রামের বজেন্দ্রনাথ চন্দ্র পাল বলেন, দুইশ টাকার মাটি কিনে আড়াই কেজি ওজনের দইয়ের পাতিল একশটার মতো হয়। মাটি প্রস্তুত করে একশটা দইয়ের পাতিল তৈরী করতে প্রায় আড়াই ঘণ্ট সময় লাগে। আর সব মিলিয়ে একজন লোকের সম্পন্ন করতে সময় লাগে প্রায় দুই থেকে আড়াইদিন। মাটি ও জ্বালানির খরচ বেড়ে গেছে। এখন পরিশ্রমের তুলনায় মাটির তৈরি জিনিসের দাম কমে গেছে।
পুলপুুলি রানী বলেন, আগে মাটি কিনতে হতো না। কিন্তু এখন মাটি কিনে কাজ করতে হচ্ছে। মাটি থেকে তৈরি অন্যান্য জিনিসপত্রের চাহিদা কমে গেছে অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের কারণে। তবে কোম্পানিগুলো দইয়ের পাতিলের কোন বিকল্প করতে না পারায় এখন এটাই ভরসা। কারণ মাটি থেকে তৈরী পাতিলে দই জমাট বাঁধতে পারে। ১ কেজি ওজনের ১শ’ দইয়ের পাতিল ৫শ’ টাকা, দেড় কেজি ওজনের ১শ’ পাতিল ৬শ’ টাকা, আড়াই কেজি ওজনের ১শ’ পাতিল ৭শ’ টাকা, তিন কেজি ওজনের ১শ’ পাতিল হাজার টাকা ধরে বিক্রি হয়।
সুধির চন্দ্র,গোপাল চন্দ্র,ত্রিদাম চন্দ্র,বজেশ্বর পাল, বলেন, বাপ-দাদার এ পেশাটিকে টিকিয়ে রাখতে কষ্ট করে হলেও করতে হচ্ছে। সম্পাদনা : মুরাদ হাসান