চিকিৎসাসেবা খাতের অব্যবস্থাপনা দূরীকরণে আমরা কি আন্তরিক?
ডা. জাকির হোসেন
চিকিৎসা প্রাপ্তিতে হয়রানি ও নানা অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে। ঢাকার মতোই দেশের অন্যান্য জেলা শহরে বেডের চেয়ে অতিরিক্ত রোগীর চাপ দেখতে পাওয়া যায়। শুধু জেলা শহরেই নয় এমনকি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে বেডের চেয়ে সবসময় রোগী ভর্তি থাকে বেশি। এই অতিরিক্ত চিকিৎসা সেবা নিতে আসা মানুষেরা হাসপাতালের করিডোর, বারান্দা এমনকি অনেক সময় সিঁড়ির ফাঁকা জায়গায় মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসকদের কাছ থেকে নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন। অতিরিক্ত চাপের ফলে হাসপাতালের পরিবেশে অবস্থান, বিড়াল, তেলাপোকা আর মশার উপদ্রবে মানুষকে অতিষ্ঠ হতে হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। পত্রিকার পাতাজুড়ে সবসময় চিকিৎসকদের সমালোচনা ছাড়া স্বাস্থ্যখাতের আর কোনো নিউজ চোখে পড়ে না বললে কি ভুল হবে?
স্বাস্থ্যখাতের হাজারও অব্যবস্থাপনা দেশের সাধারণ রোগীদের জীবন আস্তে আস্তে নিঃশেষ করে দিচ্ছে তেমনি এই ভোগান্তির অর্থনৈতিক চাপ পড়ছে রোগীর পরিবার থেকে শুরু করে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উপর। দেশের নেতৃত্বস্থানীয় মানুষেরা সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের আশায় স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে অনেক মন্তব্যই করেন। কিন্তু সত্যিকারের যে সমস্যাগুলো দূর করলে সার্বিকভাবে একজন রোগী থেকে শুরু করে রোগীর পরিবার এমনকি রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে উপকৃত হবে সে ব্যাপারে তারা মুখ খুলেন না। কারণ এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে যেমন একটি সঠিক পরিকল্পনার দরকার আছে তেমন দরকার আছে সরকারে প্রশাসনিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন। এই সব দুর্বলতার ব্যাপারে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিও একেবারেই মুখ খুলেন না। তারা খুব সহজ একটা বক্তৃতা বা বিবৃতি দেন তা হলোÑ আমরা জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দিয়েছি। এই ঘোষণায় যে কত বড় ফাঁক রয়েছে তা কেউ রোগী হয়ে হাসপাতালে ভর্তি না হলে বুঝতে পারবেন না।
স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের লক্ষ্যে লিখছি। মানুষকে সচেতন করা ছাড়া এই সেবার শতভাগ সুফল কখনই জনগণ পাবে না। একটা ছোট উদাহরণ দিইÑ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল। যত সরকারি হাসপাতাল রয়েছে এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সবচেয়ে সুন্দর। এই সুন্দর পরিবেশ ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে এটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে। এখানে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের যত হাসপাতাল আছে প্রায় সব হাসপাতাল থেকে রেফার হয়ে রোগী আসেন। এখানে স্বচ্ছল পরিবারের রোগীরা যেমন চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন, তেমনি আসেন একেবারেই হতদরিদ্র পরিবারের রোগীরাও। যে সকল রোগী একেবারেই দরিদ্র শ্রেণির তাদের বেশির ভাগেরই ঢাকা শহরে কোনো আত্বীয়-স্বজন থাকে না। স্বাভাবিকভাবেই তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে প্রতিদিনের জীবন পরিচালনা করতে হয়। এই সকল দরিদ্র পরিবারের লোকজন টাকার অভাবে রাতে রাস্তায় রাত কাটিয়ে দেয়। খুব সহজেই এই মানুষগুলোর প্রাত্যহিক ব্যয় অনেকাংশে কমিয়ে আনা যেত। বলেছিলাম বাংলাদেশের যত সরকারি হাসপাতাল আছে এদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সবচেয়ে ভালো। কিন্তু এই ভালো কি রোগীর আর্থিক কষ্ট লাঘব করতে পেরেছে? পারেনি।
সারাদেশের সব সরকারি হাসপাতালের মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালেও যে পানি সরবরাহ করা হয় তা খাবারের অযোগ্য। শুধু বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করে তাদের আর্থিক সংকট যেমন লাঘব হতো তেমনি রোগীদের জন্যও তা হতো সুস্বাস্থ্যকর। কিন্তু এই পানি সরবরাহের সেক্টরটি চিকিৎসকরা নিয়ন্ত্রণ করেন না। এখানে চিকিৎসকদের আক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। চিকিৎসকেরা মেঝেতে রেখেও চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। কিন্তু এই সকল রোগীদের সামগ্রিক সেবা কখনই চিকিৎসকদের একার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। একটি ছোট উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, যে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন আসলে চিকিৎসক ছাড়া অন্য কেউ চান কি না। যদি সত্যিকারার্থেই কেউ এই সেবার মান উন্নয়ন করতে চাইতেন তাহলে স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নয়নে কথার চেয়ে কাজটি বেশি করতেন। কিন্তু অব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করার মানসিকতা দেশের সকল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর চরম অনীহা রয়েছে বলেই প্রতিয়মান হয় দৃশ্যমান বিভিন্ন কর্মকা-ে। আগেই বলেছি, অনেকে সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের আশায় প্রতিনিয়ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অপ্রপ্রচার চালান। কিন্তু বাস্তবে চিকিৎসকদের মতো কঠোর শ্রম দিয়ে স্বাস্থ্যসেবাকে আরও সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার মতো নেতৃত্বের বড় অভাব রয়েছে।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান