কবর নয় মুসলিমদের দাহ করতে চান ভারতের বিজেপি এমপি! কিন্তু কেন…
হুমায়ুন আইয়ুব
কবর হলো মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে রাখার গর্ত। মৃত মানুষকে কবরে শায়িত করাকে বলা হয়- দাফন করা। মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের মৃতদেহ মাটিতে দাফন করা হয়। অন্যদিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিন্দুদের মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। তবে হিন্দুধর্মে সাধুদের সমাধিস্ত বা কবরের প্রচলন আছে।
সম্প্রতি ভারতের বসবাসরত মুসলমানদের কবর নয়, তাদের দাহ করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির ক্ষমতাসীন বিজেপির সংসদ সদস্য সাক্ষী মহারাজ। এক ট্রুইট বার্তায় ভারতের এই বিতর্কিত এমপি বলেন, কবরস্থান হোক কিংবা শ্মশ্মান, সবাইকে দাহ করা উচিত। কাউকে কবর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। সূত্র : ইন্ডিয়া ডটকম
প্রথমত বিষয় হলো, বিজেপির সাংসদের মতামত খোদ হিন্দু ধর্মেরই বিপরীত। কেননা সনাতন হিন্দু ধর্মেও দাহ করার পাশাপাশি কবরের প্রচলন রয়েছে। হিন্দু সাধকদের সাধারণত দাহ করা হয় না। সমাধিস্ত দেওয়া হয়।
তাছাড়া কোন মৃত্যের বয়স যদি ৫ বছরের কম হয় তাকেও দাহ নয়; কবর দিতে হয়। হিন্দু সমাজের মধ্যে একটি বৃহত্তম অংশ চৈতন্যদেবের অনুসারী- বৈষ্ণব সমাজ, মৃতদেহকে পোড়ায় না, তারা কবর দেয় বা সমাহিত করে, কিন্তু এটি মুসলমানদের মতো শায়িত অবস্থায় কবর নয়, বসে থেকে পূর্বমুখী হয়ে ধ্যান করছে, এমন অবস্থায় সম্পূর্ণ সন্ন্যাসী বেশে তাদেরকে সমাহিত করা হয়। মজার বিষয় হলো, অতি সম্প্রতি তামিলনাডুর সদ্য প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রীর জয়াললিতাকেও দাহ না করে, কবর দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও জয়াললিতার রাজনৈতিক গুরু, এম. জি. রামচন্দ্র, এবং দ্রাবিড় রাজনীতির জন্মদাতা আন্না দুরাইকেও কবর দেওয়া হয়েছিল বঙ্গোপসাগরের তীরে চেন্নাইয়ের মারিনা তটে।
ধর্মীয় রীতি ও স্বাভাবিক প্রচলনে হিন্দুদের দাহ করা হয়। কিন্তু মুসলিমসহ পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মই কবরের ব্যাপারে ঐকমত্য। তবুও বিজেপির সংসদ সদস্য সাক্ষী মহারাজ কেন মুসলিমদের দাহ করতে চান?
প্রথমত বিষয়, ‘মুসলমানদের কবর নয়, তাদের দাহ করা উচিত’ সাক্ষী মহারাজের এই মতামত অতি সম্প্রদায়িক মানসিকতা ও ধর্মবিদ্বেষ। তার এই সম্প্রদায়িক উস্কানির ফলে দেশে দেশে আশান্তি-অপ্রয়োজনীয় তর্ক ইত্যাদির সূত্রপাত হবে।
আরও বলাবার বিষয় হলো, ১২ লক্ষ, ৬৯ হাজার, ৩৪৬ বর্গ মাইলের ভারতে কেন কবরের জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে? সুবিশাল এই ভারতে হিন্দু সাধাক ও মুসলিমদের কবরের জায়গা নিয়ে প্রশ্ন করা এখতিয়ার কি সাক্ষী মহারাজের আছে? কেননা সাংবিধানিকভাবেও ধর্মীয় অধিকার নিশ্চত করা ভারতের-ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সুতরাং যে যার ধর্মীয় রীতি-নীতি যথাযতভাবে পালন করবে।
মুসলিমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে-মৃত্যুর পর কবর দেওয়া একটি ইবাদত। কবর সংস্কৃতির মাঝেই মুসলিমরা আত্মমর্যাদাবোধ করেন। পেছনে ফিরে থাকালে দেখা যায়, পৃথিবীর প্রথম মানুষ হজরত আদম আ.-এর ছেলে কাবিল তার ভাই হাবিলকে হত্যা করে, মাটিতে পুঁতে কবর দিয়েছিল। এটিই পৃথিবীর প্রথম কবর। আসমানি সকল ধর্মও তাই কবর ধারনায় বিশ্বাসী।
মনে রাখার মতো বিষয় হলো, পৃথিবীতে মানুষই সবচেয়ে মর্যাদাবান। তারাভরা আকাশ, জোছনা ভরা রাত বিছিয়ে রাখা বিস্তৃত সবুজ ভূমি সব আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি। আল্লাহ তায়ালার সব সৃষ্টিই মানুষের কল্যাণে। মানুষের প্রয়োজনে। মানবজাতিকে মর্যাদাবান করার জন্য মহান প্রভু মানুষের অবয়ব ও কাঠামোগত সৌন্দর্য, বিবেক-বুদ্ধি ও জ্ঞান-গরিমায় উন্নতি দিয়েছেন। দিয়েছেন ভাব-ভাষা ও শৈলীর শক্তি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে সৃষ্টি করেছি। (সূরা তিন ৪)।
মানুষের মন-মনন, চিন্তা-চেতনা ও জ্ঞানের মর্যাদা প্রদানে কোরআন বলেছে, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে এমন জ্ঞান দান করেছেন যা সে জানত না। (সূরা আলাক ৫)।
আল্লাহ আরও বলেছেন, আমি আদমকে বস্তু জগতের সব জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছি। (সূরা বাকারা ৩৩)।
সমগ্র সৃষ্টির তুলনায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কথা কোরআন এভাবে উচ্চারণ করছে, আমি তো মানুষকে মর্যাদা দান করেছি, জলে ও স্থলে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি, তাদের উত্তম রিজিক দিয়েছি। সৃষ্টির অনেকের ওপর আমি মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। (সূরা বনি ইসরাইল ৭০)।
শ্রেষ্ঠত্বের এই ধারাবাহিকতা শুধু জীবিতের জন্য নয়, মৃতের জন্য প্রয়োজন। ইসলাম মনে করে, জীবিত মানুষ যেমন মর্যাদাশীল, মৃত্যুর পরও সেই মর্যাদার দাবি রাখে। তাই কোরআনের সুরা আবাসায় বলেছে, তারপর আল্লাহ তাকে মৃত্যুদেন এবং তাকে কবরস্ত করেন। তারপর যখন তিনি ইচ্ছা করবেন, তাকে পুনর্জীবিত করবেন।
কোরআনের এই যে কবরপ্রচলন- নিশ্চয় তা মানুষের মৃত্যুর পরও মর্যাদা অব্যাহত রাখার স্বার্থে।
তাফসিরে সফওয়াতুত তাফাসিরে আল্লামা খাজেন রহ. বলেন, কবররীতির এই ধারা মানুষের মর্যাদার জন্য। মানুষ জীবিত থাকলেও সম্মানিত, মৃত্যুর পরও সম্মানিত। ৩/৪৯০
শুধু যুক্তি-তর্ক আর তথাকথিত গবেষণায় বেলুন উড়িয়ে লাভ নেই; পৃথিবীর চিরায়ত ধারার চলমান কবরের সংস্কৃতি মানুষের জন্য কল্যাণকর। সবার ধর্ম-মতের মানুষের চিন্তা চেতনা আদর্শ ও মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই কথা বলা উচিত। সাক্ষী মহারাজের মতো দায়িত্বশীলরা আরো সতর্ক হবেন বলেই ধারণা করি।
যড়সধঁহধুঁন@ুধযড়ড়.পড়স