‘বাংলাদেশ’ ও ‘আমার সোনার বাংলা’ নির্ধারণ করা হয় ৩ মার্চ
উম্মুল ওয়ারা সুইটি : ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত পল্টনের সমাবেশ থেকে অসহযোগ অন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্র-জনতার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর সামনে সেদিন স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারন সম্পাদক শজাহান সিরাজ।
তখনই নির্ধারণ করা হয় দেশের নাম হবে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারিত হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’। ১মার্চ পাকিস্তান সরকারের গণত্যার প্রতিবাদে সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।এতে সভাপতিত্ব করেন ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী। সভায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি পূর্ন আস্থা স্থাপন করে স্বাধীনতা সংগ্রামে জনতার সাথে একাত্বতা ঘোষনা করা হয়। এর আগে ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অর্ধদিবস হরতালে রাজধানীতে শহীদ হন ২৫ মুক্তিকামী জনতা, আর আহত হন দেড়শতাধিক। চট্টগ্রামে এ দিনে শহীদ হন ৭৫ জন, আহত হন প্রায় আড়াইশোর মত মুক্তি পাগল জনতা। তার প্রতিবাদে ৩ মার্চ উত্তাল ছিলো পল্টন ময়দান। বিক্ষোভে উত্তাল এই দিনে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রলীগের বিশাল জনসভা। প্রথম দিকে বক্তৃতা করেন ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের নেতারা। তাদের জ্বালাময়ী ভাষণে ধ্বনিত হয় স্বাধীনতার সংকল্প। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার আহবান জানান। তিনি বলেন, গণ প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে । নইলে বাংলার মানুষ সরকারকে কোন রকম সহযোগিতা করবে না । কর-খাজনা বন্ধ করে দেবে।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। এতে তিনি সরেজমিনে বাংলাদেশ সফর করে বাংলাদেশের অবস্থা জেনে যাওয়ার জন্য তার প্রতি আহবান জানান । পরিস্থিতি সামাল দিতে এ দিনে এক আলোচনা প্রস্তাব দেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান ।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে কিছুটা শংকিত হয় পাকিস্তান সরকার। ঢাকা প্রতিরোধের খবর যেন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে না পারে, দুর্বার আন্দোলনের খবর যেন প্রকাশিত হতে না পারে, সেজন্য পাকিস্তানী সামরিক জান্তা সংবাদপত্রে সেন্সর আরোপ করেছিল। এদিন ১১০ নম্বর সামরিক আদেশ জারি করা হয়। পত্র-পত্রিকায় পাকিস্তানের বা সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী খবর, মতামত বা চিত্র প্রকাশ ও নিষিদ্ধ করা হয়। আদেশ লঙ্ঘনে ১০ বছরের কারাদ-ের বিধান ছিল। শুধু সেন্সরশিপ আরোপই নয়, কোনোভাবেই যেন বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামের খবর বিশ্বে পৌঁছতে না পাওে সেজন্য প্রতিটি সংবাদপত্রের অফিসে ফোনসহ সশরীরে গিয়ে হুমকি-ধমকিও দেয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধের দলিল ও প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য থেকে জানা যায়,১৯৭১ সালের ৩ মার্চের ডাকা নির্ধারিত সংসদ অধিবেশন বাতিল করার পর অন্যান্য জেলার মতো রংপুর জেলার বিক্ষুব্ধ জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রংপুর জেলা শাখার সভাপতি রফিকুল ইসলাম গোলাপের সভাপতিত্বে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ছাত্রলীগ নেতাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গভীর রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে আন্দোলনের পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করা হয়। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মমতাজ জাকির আহমেদ সাবু, ছাত্র নেতা হারেস উদ্দিন সরকার, অলোক সরকার, ইলিয়াস আহমেদ, আবুল মনসুর আহমেদ, মাহবুবুল বারি, মুখতার এলাহি, আব্দুর রউফ, জিয়াউল হক, জায়েদুল ইসলাম এবং নুরুল হাসান বৈঠকে যোগ দেন।
ছাত্র নেতা আব্দুর রউফ গভীর রাতে বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসেন এবং রংপুর প্রেসক্লাবে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের জানান, বঙ্গবন্ধুর ডাকে আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই।
রংপুরে ৩ মার্চ কারফিউ ভেঙ্গে হাজার হাজার লোক বিক্ষোভ মিছিল করে। পাকিস্তান শাসকের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। স্বাধীনতাকামী বাঙালী বিক্ষোভ মিছিল করে। মিছিলটি নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মিছিলে শ্লোগানের ভাষা ছিল তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব। ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মার বাংলাদেশ স্বাধীন কর। সকাল ৯টায় নগরীর খাদ্য গুদামের কাছে আলমনগর এলাকায় বিহারী সরফোরাজ খান তার বাড়ি থেকে মিছিলের উপর গুলি চালায়। এ সময় ১২ বছর বয়সের কিশোর সাঙ্গকু সমজদার গুরুতর আহত হয়। রংপুর পৌরসভার কাউন্সিলর মোসলেম উদ্দিন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথে সমজদার মারা যায়। প্রথম শহীদ সমজদার। সাঙ্গকুর’র মারা যাবার খবর মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার লোক রাস্তায় বেরিয়ে আসে এবং মিছিলে যোগ দেয়। নগরীতে বিহারীদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়া হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা এক পর্যায়ে বিহারী সরফোরাজ খানের বাড়িতে হামলা চালায়। পাকিস্তানী এবং নন বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আন্দোলন আরো জোরদার করার আশ্বাস দিয়ে ডা. সোলায়মান আলী এমএনএ জ্বালাময়ী বক্তব্য দেয়ার পর বিক্ষুব্ধ জনতা কিছুটা শান্ত হয়। ৩ মার্চ নগরীতে নন বেঙ্গলী বিহারীদের হামলায় আরো দু’জন বাঙ্গালী নিহত হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে রংপুর নগরীতে প্রতিটি বাঙ্গালী আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।
নগরীর বাতার গোলি মোড় এলাকায় বিহারীর গুলিতে রংপুর কলেজ ছাত্র আবুল কালাম আজাদ নিহত হয়। অপরদিকে নগরীর দেওয়ানবাড়ি সড়কে ছুরিকাঘাতে একজন সরকারি কর্মচারী নিহত হন। রংপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে ৩ মার্চে রংপুরে শাহাদতবরণকারী এই চার বীর তরুণের নাম উল্লেখ করেন। সম্পাদনা: এনামুল হক