কারফিউ তুলে নিয়ে নতুন কৌশলে যায় পাকিস্তানী শাসক
উম্মুল ওয়ারা সুইটি: সাধারণ নির্বাচনের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা। বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা হয়নি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। একের পর এক কথার বরখেলাপের ফলে বঙ্গবন্ধু ও সে সময়কার রাজনীতিকরা বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানি শাসকরা বড় ধরনের ষড়যন্ত্র করছে। এদিকে বঙ্গবন্ধুও বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিলেন। এ নিয়ে ফেব্রুয়ারি থেকে ছাত্র সংগঠন ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক এবং সভা-সমাবেশ অব্যাহত রাখছিলেন বঙ্গবন্ধু। শেষে ১ মার্চ থেকে পরিস্থিতি আরও উত্তাল হতে থাকে। ৩ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ওই দিন রংপুরসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় ছাত্রদের উপর পুলিশের নির্যাতন চলে। তিনজন ছাত্র নিহত হয়। এই পরিস্থিতি ঢাকায় কর্মসূচি জোরাল হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পাকিস্তান সরকার ঢাকাসহ সারাদেশে কারফিউ জারি করে। কিন্তু তাতেও ছাত্র ও জনতার আন্দোলন থামাতে পারেনি। দিনে দিনে আন্দোলন জোরালো হতে থাকলে, পাকিস্তান সরকার নতুন কৌশল নেয়। ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ ঢাকা থেকে কারফিউ তুলে নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। তবে তখন পরিস্থিতি ছিল থমথমে।
পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত দৈনিক ‘দ্য ডন’ পত্রিকা দিনের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর ঢাকা থেকে জানিয়েছিল, সামরিক শাসক কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেদিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কারফিউ তুলে নেওয়ার পর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ঘোষণায় বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান শান্তির আহবান জানানোর পর গত ২৪ ঘণ্টায় সাধারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আগে বুধবার ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভা থেকে অবিলম্বে নগরী থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়ে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। এরপর থেকে রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্যান্য সংগঠন অবিলম্বে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবি জানায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে এদিন সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। রাজধানীতে সেদিন ছিলো হরতালের চতুর্থ দিন এবং প্রদেশে ছিলো তৃতীয় দিন। আওয়ামী লীগ প্রধান পরের দিনও হরতাল পালনের ঘোষণা দেন।
১৯৭১ সালের ৫ মার্চ সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য ব্যাংক এবং অন্যান্য অফিস দুই ঘণ্টার জন্য খোলা রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগের দিন ব্যাংক ও অফিস দুই ঘণ্টা খোলা রাখার নির্দেশ দেন। দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ব্যাংক ও অফিস খোলা ছিল।
৫ মার্চ টঙ্গিতে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুই জনের মৃত্যু হয়। টঙ্গিতে টেলিফোন শিল্পে নিরাপত্তাবাহিনী গুলি চালালে একজন নিহত এবং ১৫ জন আহত হয়। রাজশাহীতে বুধবার নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা মিছিলে গুলি চালালে একজন নিহত এবং ৪ জন আহত হয়। জেলা প্রশাসনের একজন মুখপাত্র সংবাদ সংস্থা পিপিকে জানান, মালোপাড়ায় টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সামনে গোলযোগের সূত্রপাত ঘটে।
সেদিনের খবরে বলা হয়, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ৩ মার্চের পর থেকে শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালিত হয়। ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ রংপুরে সন্ধ্যা থেকে দশ ঘণ্টার কারফিউ জারি করা হয়। তখন এদিনে ঢাকায় এবং দেশের অন্যান্য স্থানে পৃথক পৃথক সমাবেশ ও মিছিল হয়। দুপুর দুইটার পর ঢাকায় জনজীবন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। রাস্তায় যান চলাচল করে। হরতাল শেষে কিছু কিছু দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা হয়। ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঢাকার বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে একটি লাঠি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মিছিল শেষে তারা পুনরায় বায়তুল মোকাররম এলাকায় সমবেত হয়ে সমাবেশ করে। পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটি সমাবেশ করে। সমাবেশ শেষে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) এবং বাংলা ছাত্রলীগ নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করে। তারা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। নগরীর জিন্নাহ এভিনিউ, বায়তুল মোকাররম, স্টেডিয়াম ও নিউমার্কেট এলাকার দোকানপাট হরতাল শেষেও বন্ধ ছিল। পাকিস্তান লেখক সমিতি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিলের নিন্দা জানায়। তারা একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।