স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে ক্ষুব্ধ ইন্টার্ন ও চিকিৎসক নেতাদের কেউ কেউ চিকিৎসকদের শাস্তিদানের পদ্ধতি মিস সিস্টেম
রিকু আমির: বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন নারী চিকিৎসককে আপা ডাকা ও এর জেরে রোগীর স্বজনকে মারধর করার ঘটনায় যে চারজন চিকিৎসককের ইন্টার্নশিপ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে, সেই নির্দেশ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন ইন্টার্ন চিকিৎসক ও চিকিৎসক নেতাদের কেউ কেউ।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাবা আলাউদ্দিন সরকারের জন্য চিকিৎসা নিতে আসা সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কোনাগাতি গ্রামের আবদুর রউফ সরকার, একজন নারী ইন্টার্নি চিকিৎসককে আপা সম্বোধন করে ফ্যানের সুইচ বন্ধ করে দিতে বলেন। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেÑ ওই বাক্য বলায় চিকিৎসকরা রোগীর ছেলেকে বেধড়ক মারধর করে আটকে রাখে এবং তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার অভিযোগে রোগীর ওই স্বজনকে ১০০ বার কান ধরে উঠবস করান। রোগীর স্বজনদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠেÑ তারা ওই নারী চিকিৎকের প্রতি মানহানিকর শব্দ ও বাক্য প্রয়োগ করেন।
এ ঘটনা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নির্দেশে তদন্ত করে ডা. এমএ আল মামুন, ডা. আশিকুজ্জামান আসিফ, ডা. কুতুব উদ্দিন ও ডা. নূরজাহান বিনতে ইসলাম নাজ এর ইন্টার্নশিপ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। সেই সঙ্গে শাস্তি শেষে তাদের চারটি ভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ শেষ করতে হবে বলে ঘোষণা দেন কর্তৃপক্ষ। এর জেরে সারাদেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা রোববার কর্মবিরতি পালন শুরু করেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপর চিকিৎসকদের ক্ষুব্ধ হওয়া নিয়ে রোববার এ প্রতিবেদক কথা বলেন ঢাকার বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৬ জন ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সঙ্গে। পরিস্থিতির কারণে তারা নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে আগ্রহ দেখাননি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে কাজ করেন, এমন একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক চড়া কণ্ঠে বলেন, শাস্তি যদি দিতেই হয়, সেটা সংশ্লিষ্ট মেডিকেল কলেজ দেবে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে মন্ত্রী যে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছেন, সেটা স্পষ্ট। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ, রোগীর বাড়িও সিরাজগঞ্জ। ফ্যানের সুইচ দিতে বলার পর রোগীর ছেলে যে কিছু বাজে মন্তব্য করেছেন নারী চিকিৎসকের প্রতি, সেটা তো কোনো আমলেই নেয়নি মন্ত্রণালয়। বগুড়া মেডিকেলও এ বিষয় এড়িয়ে গেছেন মন্ত্রীর প্রভাব বলে, অভিযোগ এই চিকিৎসকের। বাকি চারজন ইন্টার্ন চিকিৎসকের মন্তব্যও একই ধাঁচের।
তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বগুড়া মেডিকেলের পাশপাশি দোষারোপ করছেন চিকিৎসক নেতাদের। তার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, চিকিৎসক নেতারা এ বিষয় থেকে একদম গুটিয়ে আছেন। সুবিধাভোগের জন্য তারা এভাবে মন্ত্রীর সঙ্গে সুসম্পর্ক টিকিয়ে রাখছেন।
এই চিকিৎসকের যুক্তিÑ বছরের বিভিন্ন সময় চিকিৎসকরা কর্মস্থলে নানাভাবে শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, বিনা কারণে জেলে পর্যন্ত যাচ্ছেন। তখন মন্ত্রণালয় কোথায় থাকেন আর চিকিৎসক নেতারা বিবৃতি দেওয়ার বাইরে কার্যকর আর কী ভূমিকা পালন করেন?
যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) নতুন মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী রোববার বিকালে এ প্রতিবেদককে বলেন, বিএমএ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। কোনোভাবেই পরিস্থিতি নষ্ট হতে দেওয়া হবে না। রোগী ও চিকিৎসক- কারও সমস্যাই কাম্য নয়। তবে চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যকার ঘটনাটি আরও তদন্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এহতেশামুল হক চৌধুরী।
নাম না প্রকাশের শর্তে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) একজন সিনিয়র নেতা রোববার সকালে এ প্রতিবেদককে বলেন, সবকিছুর একটা সিস্টেম আছে। ঘটনা ঘটতেই পারে। নিয়মানুযায়ী প্রথমে ঘটনাটির তদন্ত করা দরকার ছিল স্থানীয় প্রশাসনের। তাতে যদি না হয়, তখন আসবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে, তাতেও যদি না হয়, তখন আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বগুড়ার ঘটনাটি সরাসরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপ করাটা এই প্রটোকলকে নষ্ট ও অসম্মানিত করেছে। এটা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি যুক্তি দেখিয়ে বলেন, ঘটনাটির সঙ্গে চিকিৎসা পেশার নীতি-নৈতিকতার সম্পৃক্ততা আছে। এ অবস্থায় স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) যুক্ত হয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত। এটা খুব গ্রহণযোগ্য হতো। বাস্তবে যা হয়েছে তা মিস সিস্টেম বলে আখ্যা দেন তিনি।
রোববার সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে স্বাচিপের নতুন মহাসচিব ডা. এমএ আজিজ এ প্রতিবেদককে বলেন, ঘটনাটি আবার তদন্ত করা যেতে পারে এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার পথ আছে। একটি প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ইন্টার্ন চিকিৎসক বা অন্য চিকিৎসক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাচিপের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করেনি। তবে স্বাচিপ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। সম্পাদনা: রাশিদ