ঘুরে ফিরে নিষিদ্ধঘোষিত ৬ জঙ্গি সংগঠনই বাংলাদেশে অপতৎপরতায় লিপ্ত হচ্ছে
আজাদ হোসেন সুমন: বাংলাদেশে জঙ্গিরা ঘাপটি মেরে আছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিভিন্ন সময় নিষিদ্ধঘোষিত ৬টি জঙ্গি সংগঠন এখনো তৎপর রয়েছে। এগুলো হচ্ছে শাহাদাত-ই আল হিকমা, হরকাতুল জেহাদ, হিজবুত তাহরির, জেএমবি, জেএমজেবি ও কালেমা-ই দাওয়াত। ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ স্লোগানের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে মৌলবাদী সংগঠনের গোড়াপত্তন হয় ১৯৯২ সালে।
সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে (১৯৭৯-৮৯) বেশকিছু মুজাহিদ আফগানদের পক্ষে যুদ্ধ করেছে-যারা বাংলাদেশ থেকে সেখানে গিয়ে মুজাহিদ দলে যোগ দিয়েছিল। তালেবানদের বিজয়ে উদ্বুদ্ধ আফগান ফেরত এই ব্যক্তিরাই জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ‘হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী বাংলাদেশ’ (হুজি) নামে একটি দল গঠনের ঘোষণা দেয়। এর দুই বছর পরে টাঙ্গাইলের করটিয়ায় বায়েজিদ খান পন্নি ওরফে সেলিম পন্নির নেতৃত্বে ‘কোমরে হাতুরী’ সংগঠন ‘হিজবুত তাওহীদ’ আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৯৮ সালে হুজি থেকে বেরিয়ে এসে শায়খ আব্দুর রহমান জামালপুরে ‘জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ’ (জেএমবি) গঠন করে। শায়খ আব্দুর রহমানের পরামর্শে সিদ্দিকুল ইসলাম ‘বাংলা ভাই’- এর নেতৃত্বে জেএমবির আরেকটি অংশ ‘জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ’ (জেএমজিবি) গঠন করে। পরের বছর কাওসার হুসাইন সিদ্দিকী নামে একজন গড়ে তোলেন আরেকটি জঙ্গি সংগঠন শাহাদাত-ই আল হিকমা। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের অংশ হিসেবে ২০০১ সালে ‘হিযবুত তাহরীর’ ও ২০০৭-০৮ সালে ‘আনসারল্লাহ বাংলা টিম’ (এবিটি) বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ করে।
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার সূচনা হয় ১৯৯৯ সালে। হুজি প্রথম হামলা করেছিল কবি শামসুর রাহমানের ওপর। তবে সেবার মার্চে বড় আকারে প্রথম বোমা হামলা হয় যশোরে উদীচী সম্মেলনে। এ হামলায় ১০ জন নিহত এবং ১৫০ জনের বেশি আহত হয়। উদীচীর রেশ কাটতে না কাটতেই খুলনা শহরে আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলায় ৮ জন নিহত হয়। ২০০১ সালের শুরুতেই রাজধানীর পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সমাবেশে বোমা হামলা হয়। এতে ঘটনাস্থলেই চারজন এবং পরে একজন হাসপাতালে মারা যান। তিন মাস পার না হতেই রমনার বটমূলে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০জন নিহত হন। সেই বছরই জুনে গোপালগঞ্জের বানিয়াচং গির্জায় প্রার্থনা চলাকালে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হন এবং আহত হন অর্ধশত। একই বছরের সেপ্টেম্বরে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে বাগেরহাটের মোল্লারহাটে খলিলুর রহমান ডিগ্রি কলেজ মাঠে এক নির্বাচনি জনসভায় রিমোট কন্ট্র্রোলনিয়ন্ত্রিত শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে ৮ জন নিহত ও ৫০ জন আহত হয়। অনুমিত যে, এই সব হামলাতেই হুজি সদস্যরা জড়িত ছিল। এরপরে বছরখানেকের বিরতি। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে আরেক নির্বাচনি আলোচনা সভায় বোমা বিস্ফোরণে ৪ জন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। মাত্র দুই দিন পরে সাতক্ষীরা শহরের একটি সিনেমা হল ও স্টেডিয়ামে সার্কাসের প্যান্ডেলে বোমা হামলায় ৩ জন নিহত ও আহত হয় অন্তত দেড়শ মানুষ। ওই বছর বিজয়ের মাসের শুরুতে কামানের তোপের মতো আবারো গর্জে ওঠে বোমা। ময়মনসিংহ শহরে চারটি সিনেমা হলে (অজন্তা, ছায়াবাণী, অলকা ও পূরবী) দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে পরপর কয়েকটি বোমা হামলায় শিশু ও নারীসহ ১৮ জন নিহত ও দেড় শতাধিক আহত হয়। এ হামলার মধ্যদিয়ে জঙ্গিবাদী হিসেবে লাইমলাইটে আসে জেএমবি। ২০০৩ সালে সবচেয়ে বড় বোমা হামলা হয় জানুয়ারিতে। টাঙ্গাইলের সখীপুরের দরিয়াপুর গ্রামের ফালুচাঁন পাগলার মাজারে রাতে বোমা বিস্ফোরণে সাতজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। এ ছাড়াও কয়েকটি স্থানে বোমা হামলা হয় যার মধ্যে রয়েছে খুলনার বাণিজ্যমেলায় কর্তব্যরত পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপ, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশে বোমা বিস্ফোরণ, খুলনায় অ্যাডভোকেট মঞ্জুর ইমামের ওপর বোমা নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ এবং খুলনা বাস টার্মিনালে একটি পরিবহনের গাড়িতে বোমা হামলা। এ সব হামলায় মোট চারজন নিহত হয়।
বোমা ও গ্রেনেড হামলার কারণে শুধু ২০০৪ সালেই শতাধিক লোক প্রাণ হারায়। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপির সরকার ৪টি এবং এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ এ ক্ষমতায় গিয়ে ২টি জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও তারা থেমে নেই। বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন নামে তারা আত্মপ্রকাশ করে। সবশেষে আত্মপ্রকাশ করে গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিষিদ্ধ হওয়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর তৎপরতায় আপাতত তারা ঘাপটি মেরে থাকলেও তারা আছে। গোয়েন্দা সূত্রগুলো নিশ্চিত হয়েছে। তারা ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করছে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছে। সুযোগ পেলেই তারা কাল কেউটের তো ছোবল দিতে পারে। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার ও কাউন্টার টেরোরিজম প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, জঙ্গিরা নেই একথা বলব না। আছে, তবে তারা ঘাপটি মেরে আছে। সক্রিয় নেই। আমাদের সোর্স- ও গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত আছে। তারা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করলেই এখন আমরা জেনে যাচ্ছি। ফলে তারা এখন আর আগের তো সুবিধা করতে পারবে না। সম্পাদনা: রাশিদ