মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে ৭ মার্চ। যদিও তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। তথাপি ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা থেকে পূর্ব বাংলার জনগণের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নির্বাচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ঘোষণাময় ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে তিনি কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা লাভের পথ রচনা করে দেন। এখান থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবেই আন্দোলন সংগ্রামে সকল স্তরের জনসম্পৃক্ততা ঘটিয়ে প্রয়োজনে বিপ্লবাত্মক যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করার অপরিহার্য কাজসমূহ তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ পূর্ববর্তী সৃষ্ট রাজনৈতিক ঘূর্ণিঝড়কে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ তার ঐতিহাসিক ভাষণে একটি যথার্থ গতিপ্রবাহ ঠিক করে দিলেন, যার ফলে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এখানকার সম্মিলিত জনশক্তি ভেঙে তছনছ করে দিতে সক্ষম হয় বা উড়িয়ে নিক্ষেপ করে দিতে পারে। ৭ মার্চ পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সেই প্রস্তুতিও শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে যেভাবে ঘুরে দাঁড়ায় তার ফলে সামরিক বাহিনীর নেওয়া অপারেশন সার্চ লাইট নামে খ্যাত গণহত্যার পৈশাচিক আক্রমণকেও সকল স্তরের মানুষ প্রতিহত করতে থাকে। একটি নিরস্ত্র জনগোষ্ঠী সশস্ত্র প্রতিরোধ এবং মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর ৭ মার্চে উচ্চারিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক সফল সমাপ্তি ঘটে। প্রকৃতই মহান মুক্তিযুদ্ধের ডাক ৭ মার্চই বঙ্গবন্ধু দিয়ে যান, ২৬ মার্চের আনুষ্ঠানিকতা ১৬ ডিসেম্বর শুরু হয়, এর বিজয় লাভ হয়।
১০ জানুয়ারি তিনি স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের এমন ইতিহাস সাড়ে সাত কোটি মানুষের আত্মত্যাগে মহিমান্বিত, গৌরবজ্জ্বলিত এবং বীরত্বগাঁথা নানা অধ্যায়ে সমৃদ্ধ। এমন মহান ইতিহাস এ ভূ-খ-ের প্রতিটি বাঙালি ও নৃ-জাতিগোষ্ঠীর হাজার বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রতিটি নারী-পুরুষ এই ইতিহাসের মর্মার্থ অনুধাবন করার মাধ্যমে সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা লাভ করবে। দারিদ্র্য বিমোচন, উন্নত জীবন লাভ, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ একটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা লাভ করার প্রাণশক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সমগ্রতার মধ্যে। ৭ মার্চ এই ইতিহাসের অগ্রবর্তী অন্যতম মহান দিন, যেদিন স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু সমগ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতার পথ দেখিয়ে দিলেন। তার রেখে যাওয়া পথে সংগঠিত হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। ইতিহাসের প্রকৃত যাদুমন্ত্রের শিক্ষা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ দিয়েছে, এখনো দিচ্ছে, ভবিষ্যতেও দিয়ে যাবে। প্রয়োজনে ইতিহাসের চোখ দিয়ে ৭ মার্চকে দেখা, ৭ মার্চের মন দিয়ে দিবসটিকে বোঝা, কান দিয়ে এর বাণী শ্রবণ করা। সেই শিক্ষা নেওয়াই আজকের দিনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস, বাংলাদেশের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়