অতিমাত্রার নির্ভরশীলতা অর্জন থেকেই ইন্টার্নরা কর্মবিরতি-ধর্মঘটে উৎসাহী
রিকু আমির: নিজ দায়িত্বের বেশকিছু অংশ সিনিয়র চিকিৎসকরা ইন্টার্ন চিকিৎসকদের দিয়ে পালন করান। এতে করে ইন্টার্ন চিকিৎসকের উপর এক ধরনের অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা তৈরি হয়। এই অতিমাত্রার নির্ভরশীলতা শুধুমাত্র সিনিয়র চিকিৎসকদের মধ্যেই তৈরি হয় না, সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল প্রশাসনেরও তৈরি হয় সিনিয়র চিকিৎসদের কারণে। এই অতিমাত্রার নির্ভরশীলতা পুঁজি করেই ইন্টার্ন চিকিৎসকরা তুচ্ছ ঘটনার জেরেও ধর্মঘট বা কর্মবিরতির মতন কর্মসূচি পালনে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ইন্টার্ন চিকিৎসক ও রোগীর স্বজন মধ্যকার ঘটনা কেন্দ্র করে গত ৩, ৪ ও আজ ৫ মার্চ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মবিরতি পালন করে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। এতে করে সেসব হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় স্থবিরতা সৃষ্টি হয়, রোগীরা ভোগান্তির জালে জড়িয়ে যান।
শুধু এ ঘটনাই নয়, গত ১০ বছরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী-রোগীর স্বজন বনাম ইন্টার্ন চিকিৎসক মধ্যকার ঘটনায় স্থানীয় ও পুরো দেশ পর্যায়ে ২৫টিরও বেশি কর্মবিরতি বা ধর্মঘট পালনের ঘটনা ঘটেছে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের উদ্যোগে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের মন রক্ষার্থে বা প্রভাব প্রতিপত্তি জয়ে রাখতে, চাঙ্গা রাখতে চিকিৎসক নেতাদের এ কর্মসূচির সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। কোনো কোনো চিকিৎসক দেখাদেখি থেকে কর্মসূচিতে জড়িয়ে পড়েন। এতে করে হাসপাতাল প্রশাসনের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব না পড়লেও রোগীরা চরম ভোগান্তিতে পড়ে যান।
ইন্টার্ন চিকিৎসকদের উপর সিনিয়র চিকিৎসকদের নির্ভরশীলতা নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সংশ্লিষ্ট অনেকেই নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি এ প্রতিবেদকের সঙ্গে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের কর্মরত একজন নারী ইন্টার্ন চিকিৎসক এ প্রতিবেদককে বলেন, শিক্ষকরা আমাদের ভীষণ চাপে রাখেন। শিখতে এসেছি ঠিকই, কিন্তু শিক্ষকরা আমাদের উপর প্রায়শই তাদের দায়িত্বগুলো চাপিয়ে দেন। এতে করে মনমানসিকতা কর্ম উপযোগী রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
ঢাকা মেডিকেলেই একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক কাজ করছেন সার্জারি বিভাগে। তিনি বলেন, রোগীতো বহুত, লোক কম। কয়দিকে যাব। স্যারদের অর্ডার পালন করতে হয় আবার রোগীও সামলাতে হয়। এসব করে আসলে মেজাজ ঠিক রাখা যায় না।
এ প্রতিবেদকের পূর্ব পরিচিত রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন ইন্টার্ন চিকিসক গত শনিবার ব্যক্তিগত কাজে ঢাকায় আসেন। রোববার তার কাছে এ বিষয় জানতে চাইলে বলেন, স্যারেরা আমাদের দিয়ে নিজের অনেক কাজই করিয়ে নেন। কিছু তো বলা যায় না। ভয় আছে, তার কথা না শুনলে যদি আমাদের জন্য নেগেটিভ কিছু করে বসেন, ক্যারিয়ারটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিনিয়র চিকিৎসকদের অনেকেই ইন্টার্ন চিকিৎসকদের দিয়ে রোগী ভর্তির কাজ থেকে, রোগ শনাক্তকরণের ব্যবস্থা, রোগীদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, ছাড়পত্র প্রদানসহ নিজের ভাগের বেশকিছু কাজ করান। অনেক ক্ষেত্রে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা বিশ্রাম বা বিনোদনের কোনো সুযোগও পান না।
ঢাকা মেডিকেল থেকে ইন্টার্নশিপ শেষ করা একজন চিকিৎসক তার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে নাম না প্রকাশের শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, দম বের হয়ে যেতো।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান সোমবার বিকালে এ প্রতিবেদককে বলেন, শুধু চিকিৎসা পেশাতেই নির্ভরশীলতা আছে, এমন নয়। সব পেশা-চাকরি-ব্যবসায়তে নির্ভরশীলতা আছে। নয়তো এসব করা যেতো না। এখন নির্ভরশীলতা আছে বলে কেউ কেউ স্ট্রাইক করতে পারে, কর্মসূচি পালন করতে পারে।
ইন্টার্ন চিকিৎসকদের উপর সিনিয়র চিকিৎসকদের অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সিনিয়ররা যা করতে বলেন, তা ইন্টার্নদের করে যাওয়া উচিত। এটাও তাদের জন্য শিক্ষা। সিনিয়র চিকিৎসকরা যেমন ইন্টার্নদের উপর নির্ভরশীল, তেমন ইন্টার্নরা সিনিয়রদের উপরও নির্ভরশীল। রোগী ক্যারিয়াউট-ফলোয়াপ এসব কাজতো ইন্টার্নরাই করে। আমিও করেছি।
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব সোমবার বিকালে এ প্রতিবেদকে বলেন, ইন্টার্নির নিজস্ব কাজ আছে, সিনিয়র চিকিৎসকদেরও নিজস্ব কাজ আছে। যে যার কাজ করবে- এটাই স্বাভাবিক। এখন কোনো ইন্টার্ন চিকিৎসক যদি মনে করেন, সিনিয়র চিকিৎসকরা তাদের উপর কাজ চাপিয়ে দিচ্ছেন, সে কথার সঙ্গে আমি কোনো ভাবেই একমত নই। সম্পাদনা: রাশিদ