স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধান : বঙ্গবন্ধুর অনন্য এক ভাষণ
ড. অনুপম সেন
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশর জন্যও তাই চেয়েছিলেন চার দশক আগে। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল বাংলার মানুষের জন্য শোষণহীন সমাজের আকাক্সক্ষা, প্রতিটি মানুষকে তার মানবসত্তার মর্যাদায় অভিষিক্ত করার আকাক্সক্ষা। এই কারণেই সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ঘোষিত হয়েছিল এই অঙ্গীকার, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে’ (সংবিধান)। অঙ্গীকারে আরও বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন’ (সংবিধান)। আরও যুক্ত হয়েছে, ‘মেহনতি মানুষকে কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা’ (সংবিধান)।
চার. বাংলাদেশকে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক আধুনিক জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে করা হয় রাষ্ট্রের সংবিধানের অন্যতম মূলভিত্তি। বঙ্গবন্ধু সংবিধানের এই স্তম্ভটি অতি সরল সর্বজনবোধ্য ভাষায় কিন্তু তীব্র ক্ষোভ ও আবেগে ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। পঁচিশ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যাভিচারÑ এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি’ (ওই ভাষণ)।
বঙ্গবন্ধুর ৪ঠা নভেম্বরের এই ভাষণটি একটি অসাধারণ ভাষণÑ ওজোগুণ, দার্ঢ্য ও অর্থগৌরবের জন্য। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের স্বাধীনতার কথাই কেবল বলেননি, মুক্তির কথা বলেছিলেন; সেই মুক্তির অঙ্গীকারই ৭২-এর সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভে রূপ পেয়েছে। তিনি সংবিধান উপস্থাপনের এই অনন্য ঐতিহাসিক ভাষণটি শেষ করেছিলেন এই বলে, ‘জনতার শাসনতন্ত্রে কোনোকিছু লেখা হয় না। …ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ গঠন করতে পারে, তাহলে আমার জীবন স্বার্থক, শহীদের রক্তদান স্বার্থক’ (ওই ভাষণ)। (শেষ)
লেখক : শিক্ষাবিদ ও উপদেষ্টাম-লীর সদস্য, আওয়ামী লীগ
সম্পাদনা: আশিক রহমান