খুব কাছ থেকে শোনা ৭ মার্চের ভাষণ এবং বঙ্গবন্ধু
রবিউল আলম
বাঙালি জাতির মুক্তির নির্দেশিত দিন ৭ মার্চ, ১৯৭১। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে, বিশ্বের বুকে ছোট্ট একটি মানচিত্র এঁকে দিয়েছে বাঙালির আবাসভূমি বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলন চলছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। আমরা বিশ্বাস করি, সেই লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে। আমরা আশাবাদী।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে ইতিহাসবিদ, সাহিত্যিক, কলামিস্ট ও খ্যাতিমান লেখকেরা লিখেন। ভবিষ্যতেও লিখবেন। আমি ৭ মার্চের সেই দিনের কথা বলতে চাই। আমার বয়স তখন ১৩, প্রতিদিনের মতো ৬ মার্চ পেশাগত চিনাবাদাম বিক্রি করে গুলিস্তান থেকে পায়ে হেঁটে রায়েরবাজার আসছিলাম। সেদিন ভালো বেচাকেনা হয়নি। ভাবলাম রমনা পার্কে গেলে হয়তো বিক্রি হবে কিছুটা, রাস্তায় কিছুটা বিক্রি বেশিই হয়েছিল।
রমনা পার্ক এলাকা থেকে দেখা যাচ্ছে অনেক লোকের সমাগম রেসকোর্স ময়দানে। কি হয়েছে তখনো বুঝতে পারছিলাম না। রেসকোর্সে ঘোড়া দৌড় হতো প্রতি রবিবার, তখন অনেক জনসমাগত হতো। কিন্তু আজ কেন এত জনসমাগম? পরক্ষণেই মনে হলো আগামীকালই তো ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন এই স্থানে। রমনা পার্ক এলাকা থেকে রেসকোর্স এলাকায় আসতেই কিছুক্ষণের মধ্যে আমার বাদাম বিক্রি শেষ হয়ে গেল। মনের আনন্দে স্থানটি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ৬ মার্চের বিকাল থেকে জনসভার লোকজন আসা শুরু হয়। অনেকের সঙ্গে হাড়ি-চুলা, চিড়া-মুড়ি নিয়ে তাবলীগ জামায়াতের মতো লোকজন আসতে থাকে। যতই সময় এগিয়ে আসছিল ততই জনসমাগম বাড়তে লাগল। তাবু করতে লাগল রাতে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। তখন যোগাযোগব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। ৭ মার্চের জনসভায় সিলেট, চিটাগাং, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশালসহ দেশের এমন কোনো জেলা শহর ছিল না যেখান থেকে লোকজন আসেনি।
বাঙালির মুক্তির আকাক্সক্ষা এতই তীব্র ছিল যে ৭ মার্চের ভাষণের পরে বাংলাদেশ কার্যত স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল, পাকিস্তানিদের জানাজা ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ভাষণ সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অফিস, পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে-গঞ্জে বাঙালির পতাকা, বাংলাদেশের পতাকা উড়তে লাগল। বাংলার বাতাসে, বাংলার আকাশে, গগন বিদারিত চিৎকার, মানুষের মুখে মুখে গাইছে জয় বাংলা বাংলার জয়। সে কি যে আনন্দ, কি যে শিহরণ জাগিয়েছিল বাংলার মানুষের মনে সেটা শুধুমাত্র ৭ মার্চের জনসভায় উপস্থিত যারা ছিলেন তারাই বুঝতে পারবেন। যাদের ওই সভায় উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়নি, জন্ম হয়নি, তাদের অনুভব করতে হবে। হাজারও লেখা লিখেও সেই অনুভূতি প্রকাশ করা যাবে না। ৭ মার্চে কি ঘটেছিল রেসকোর্স ময়দানে, কেমন ছিল ময়দানের পরিবেশ, মানুষের মনের ভাষা কেমন ছিল, কখন আসবেন বঙ্গবন্ধু, কি বলবেন যা শোনার জন্য লাখো মানুষ তিন-চারদিনের পথ পেরিয়ে হাজির হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। অবশেষে জাতির জনক এলেন। বললেন অনেক কথা। যে কথা শুনে মানুষ উদ্বেল হয়। বুকের সাহস বেড়ে দ্বিগুন হয়।
বাঙালি জেগে উঠল একটি আঙুলের ইশারায়। একটি আঙুলের ইশারা দেখতে, দুটি কথা শুনতে, নাওয়া খাওয়া করা সবই যেন মানুষ ভুলে গিয়েছিল। কি হয়েছিল মানুষের, আজ মনে হলে মনে মনে হাসি এবং ভাবি এই তো সেই রেসকোর্স ময়দান, যা আজকের সোহরাওর্দী উদ্যান। ইতিহাসের সাক্ষী। এই এলাকায় শিশুপার্ক হয়েছে, কিছু স্থানে কন্ট্রোল রুম, থানাসহ অনেক কিছু নির্মাণ হয়েছে, অনেক ছোট হয়ে গিয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। তবু ইতিহাসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের মহাসমাবেশের কাছাকাছিও কোনো মহাসমাবেশ না কেউ করতে পেরেছে, না হয়েছে, না ভবিষ্যতে বাংলার মাটিতে হবে। কোনোদিনও সম্ভব না।
৭ মার্চের ভাষণ শুনতে আসা মানুষের ঢল ছিল সেদিন। ময়দানে তিল ধারণের স্থান ছিল না। কারওয়ান বাজার, নিউ মার্কেট, পলাশি, লালবাগ, গুলিস্তান, মতিঝিল, কাকরাইল এমনকি কমলাপুর রেল স্টেশন, সদরঘাট পর্যন্ত লোক সমাগম ছিল। ঢাকা মুক্ত হতেও দুই থেকে তিনদিন লেগেছিল। এত মানুষের আগমন আমি আর কখনো দেখিনি, ভবিষ্যতে দেখব কি না জানি না। তবে মনে রাখতে হবে তখন জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, আর এখন ১৬ কোটি। তবু কি আর একটা ৭ মার্চের মতো সভা করা যাবে? যাবে না।
৭ মার্চ ইতিহাস। একটি দেশের জন্ম কথা বলে। এখনো কিছু মানুষ বেঁেচ আছে, যারা সাত মার্চ খুব কাছ থেকে দেখেছে। শুনেছে জাতির জনকের ঐতিহাসিক ভাষণ। শুধু নেই ইতিহাসের মহানায়ক জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হায়েনার দল তাকে কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু বাঙালির মন থেকে তার নাম মুছে ফেলা গেছে? যায়নি। শুধু বাঙালি নয়, বিশ্ব ইতিহাসেই জাতির জনক একটি অবিস্মরণীয় নাম। শোষিত, বঞ্চিত মানুষের সাহস ও শক্তি। সভ্যতা যতদিন থাকবে, ৭ মার্চ ততদিন থাকবে। জাতির জনকও ততদিন আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন তার কর্মের মাধ্যমে।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি
সম্পাদনা: আশিক রহমান