আমাদের অর্থনীতিকে শেষ সাক্ষাৎকারে কালিকা প্রসাদ এই বাংলাদেশটা আমার আপন ভূমি, এ দেশ আমার আরেক সত্তা
মাছুম বিল্লাহ : ‘এই বাংলাদেশটা আমার আপন ভূমি। আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি বাঙালি। এ দেশটা আমার আরেক সত্তা। ১৯৭১ সালেই আমার জন্ম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে আমরা আমাদেরও ইতিহাসের অংশ মনে করি। জন্মগতভাবেও আমি একাত্তরের সন্তান।’
গত ১ মার্চ বসুন্ধরা সিটিতে স্টার সিনেপ্লেক্সে দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে লোকজ বাংলা গানের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও দোহার ব্যান্ডের গায়ক কালিকা প্রসাদ ভট্টাচার্য নিজের ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এভাবেই অনুভূতি ব্যক্ত করেন। সম্ভবত এটাই ছিল বাংলাদেশে তার শেষ সাক্ষাতকার। সরকারি অনুদানে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের গল্পের ছবি ‘ভুবন মাঝি’ উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলনে তিনি। এই ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তিনি।
এবারের ঢাকা সফর কেমন লাগছে ? আমাদের অর্থনীতি’র এমন প্রশ্নে স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে কালিকা প্রসাদ বলেন, এই বাংলাটা আমার আপন ভূমি। আমি অনেক গান করেছি এখানে। কিন্তু কোনো ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করিনি। সেই অর্থে চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা এটাই প্রথম। আর আমি গানও লিখি না। একবার শাহবাগ আন্দোলনের সময় প্রাণের তাগিদে গান লিখেছিলাম আর এই সিনেমার জন্য লিখলাম। মুক্তিযুদ্ধেও ভারত ছিল আবার ভুবন মাঝিতেও আছে। ইতিহাস এমনই, কোনো এক জায়গাতে গিয়ে মিলে যায়। এটা খুব ভালো লাগে। এবার এসেছি ‘ভুবন মাঝি’র প্রচারে।
এই প্রথম বাংলা চলচ্চিত্রে গান পরিচালনা করছেন। কেমন লাগছে? আমাদের অর্থনীতির প্রশ্নের উত্তরে কালিকা প্রসাদ বলেন, এই চলচ্চিত্রেও মাটির ঘ্রাণ আছে। লালনের দর্শনে বিশ্বাসী একজন মানুষের একতারা ছেড়ে একাত্তরে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া নিয়ে গল্প। নামটাও সুন্দর— ‘ভুবন মাঝি’। ফখরুল আরেফিন নির্মাণ করছেন। এ চলচ্চিত্রের সঙ্গে কাজ করে ভালো লাগছে।
অনেকদিন ধরে আপনারা গান করে যাচ্ছেন। দোহারের নামকরণ কী করে হলো? অর্থনীতির পাঠকদের কি বলবেন? জবাবে কালিকা প্রসাদ বলেন, আমার ছোট কাকা অনন্ত ভট্টাচার্যের লোক বিচিত্রা নামে একটি গানের দল ছিল। একসময় আমি পড়াশোনা করার জন্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। সেখানে সাহিত্য নিয়ে পড়েছি। ১৯৯৮ সালে হঠাৎ করেই কাকা মারা যান। বেঁচে থাকা অবস্থায় তিনি প্রায়ই লোক বিচিত্রা ও লোকগান নিয়ে স্বপ্নের কথা বলতেন। কাকার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কিছু একটা করার কথা ভাবলাম। পরের বছর অনুষ্ঠান করার জন্য হল বুকিং দিলাম। তখনো কিন্তু ব্যান্ডের নাম ঠিক করা হয়নি। এরই মধ্যে অভিক মজুমদার নামে আমারই এক শিক্ষক দোহার নামটা দিলেন। ১৯৯৯ সালের ৭ আগস্ট আমরা এই ব্যান্ডটি নিয়ে যাত্রা শুরু করি।
আপনার পরিচয় নিয়ে একটা দ্বিধা কাজ করে, তা হল- কালিকার দোহার না দোহারের কালিকা? আমাদের অর্থনীতির পাঠকদের কি বলবেন? উত্তরে তিনি বলেন, আগে নিজেকে দোহারের কালিকা বলে পরিচয় দিতাম, এখন লোকেরা কালিকার দোহার বলে। কোনটাই কিছু না। দোহার দোহারই। আমিতো স্বপ্ন দেখি কালিকার পরও দোহার বেঁচে থাকবে। মানুষ তো মরণশীল।একদিন আমারও মৃত্যু হবে। সেদিনও দোহার বেঁচে থাকবে। এটাই তো দোহার প্রতিষ্ঠার স্বার্থকতা।
গানের সঙ্গে দোহার সব দেশীয় যন্ত্র ব্যবহার করে। এর কারণ কি? উত্তরে তিনি বলেন, শুরুর দিকে অনেকেই বলেছিল, এখন ব্যান্ডে কত আধুনিক বাদ্যযন্ত্র লোকজন ব্যবহার করে। অথচ তোমরা ঢোল, তবলা, কাঁসা, সারিন্দা ব্যবহার করছ। এটা কি মানুষ আদৌ শুনবে? আজকে যে বাংলাদেশে এসে গান গাইছি, সঙ্গীত পরিচালনা করছি সেটা তো অবশ্যই দেশীয় ও পুরনো বাদ্যযন্ত্রের কল্যাণেই।
দোহারের সব গানই সংগ্রহ করা। মৌলিক গান কেন করা হয় না? উত্তরে কালিকা প্রসাদ অর্থনীতিকে বলেন, আমি বড় হয়েছি দূরবীন শাহ, হাছন রাজা, লালন ফকির, আব্বাস উদ্দীনের গান শুনে। পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে এ অঞ্চলে লোকগানের ব্যাপ্তি অনেক বেশি। তবে এখন পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্পীদের গানও আমরা সংগ্রহ করছি।
ইদানীং দোহার রবীন্দ্রনাথের গানও করছে, কেন? উত্তরে কালিকা প্রসাদ বলেন, রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯০৫ সালে স্বদেশি গানের বই বের করেন তার নামও ছিল বাউল। রবীন্দ্রনাথ নিজেও কিন্তু বাউল গানের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শুধু বাউলের সুর নয় ভাবটাকে গ্রহণ করেছেন। এ সময় এসে মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়েও আমাদের ভাবা উচিত। আমরা যে আসলে নগরে এবং গ্রামের মধ্যে একটা সেতু গড়ার কথা বলি এটা সবচেয়ে বেশি বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। মূলত রবীন্দ্রনাথের এসব বিষয় নিয়ে পড়ে রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়ি বলতে পারেন। আর কিছু কিছু বিষয় আমরা একান্তই নিজেদের জন্য করে থাকি। মিডিয়া কাভারের জন্য নয়। কারণ আমি জানি মিডিয়া কোনো দিন শিল্পী তৈরি করতে পারে না। সম্পাদনা: রাশিদ