কর্মক্ষেত্রে প্রথম যে নারীরা
ইমরুল শাহেদ : আমেরিকার সোসালিস্ট পার্টির এক ঘোষণা অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রে ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করা হয়। এরপর ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ৮ মে তারিখকে সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে কর্মহীন দিবস ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রোববার রাশিয়ায় আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়।
জাতিসংঘ ১৯৭৬-৮৫ পর্যন্ত সময়কে নারী দশক ঘোষণা করে। ১৯৮৫ সালে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে বিশ্ব নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারী পুরুষ বৈষম্য বিলোপের বিষয়ে সার্বজনীন সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ৩২/১৪২ নং সিদ্ধান্তের আলোকে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে অনুরোধ করে। এর পর প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়ে আসছে।
নারী দিবসের উত্তরোত্তর অগ্রযাত্রায় প্রথম সোপান হলো নিউইয়র্কের একটি সুই কারখানার নারী শ্রমিকরা। অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তারা ট্রেড ইউনিয়নও প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু নারীর ভূমিকা আজ আর কায়িক শ্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তারা আজ বিশ্বকে নেতৃত্বও দিচ্ছে। ক্ষমতায়নের দিক থেকে নারীরা চলে এসেছে সমাজের অগ্রভাগে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী – দু’জনই নারী। পাশের দেশ মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট পুরুষ হলেও দেশ পরিচালনা করছেন শান্তিতে নোবেল পাওয়া অং সাং সুচি। নারী নেতৃত্বে সর্বশেষ উদাহরণ হলেন যুক্তরাষ্ট্রের হিলারি ক্লিন্টন। তিনি প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সুদক্ষ কূটনীতি প্রদর্শনের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এক সময়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মার্গারেট থ্যাচার নারী নেতৃত্বকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাকে বলা হতো আয়রন লেডী।
পক্ষান্তরে মাত্র ৪৬ বছর আগেই প্রতিবেশী দেশ ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন জওহরলাল নেহরুর সুযোগ্য কন্যা ইন্দিারা গান্ধী। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে যে কয়েকজন নারীর নাম পাওয়া যায় তাদের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীও একজন। প্রসঙ্গত প্রথমে দখলদার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও পরে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যেসব নারীরা লড়াই করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ঝাসির রাণী, সরোজিনী নাইডো, কাস্তুরবা গান্ধী, অরুণ আসাফ আলী, কমলা নেহরু, বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত, মাদাম কামা ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদা প্রমূখ। কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের প্রথম নারী হলেন কিত্তরের রাণী চান্নামা। তিনি ১৮২৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে থমকে দেন। এরপরেই আসে মারাঠা নারী রাণী লক্ষ্মীবাঈয়ের নাম। তিনি ১৮৫৮ সালে ইংরোজ বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৮৭৯ সালে দৃশ্যপটে দেখা যায় নবাব ওয়াজেদ আলী শাহর বিধবা স্ত্রী বেগম হযরত মহলকে। তবে ভারত উপমহাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হলেন শ্রীলংকার শ্রীমাভো বন্দেরনায়েক। তিনি তিন বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
নারী শ্রমিকদের আন্দোলন যেমন প্রথম শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তেমনি নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিও শুরু হয়েছে সেখান থেকেই। ১৯৮৪ সালে মার্কিন ডেমোক্রেটিক পার্টি ভাইস প্রেসিডেন্টের প্রথম মনোনয়ন পান জেরালডি ফেরারো। এর আগে তিনি ছিলেন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য। কিন্তু ১৯৮৫ সালে বিশ্বের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন নেদারল্যান্ড এন্টিলেসের মারিয়া লিবেরিয়া-পিটার্স। তারই এক বছর অর্থাৎ ১৯৮৬ সালে কোরাজন একুইনো ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু তার আগে ১৮৮৭ সালে কানসাসের নারী রাজনীতিবিদ হিসেবে আর্গোনিয়ার মেয়র নির্বাচিত হন সুসানা মেডোরা সলটার। ১৯২২ সালে জর্জিয়ার রেবেকা ফেলটনকে মার্কিন সিনেটের একটি অস্থায়ী শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৯৮১ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে মনোনয়ন দেন সান্দ্রা ডে ও’কনরকে। সিনেট ভোটে একবাক্যেই তিনি বিচারপতি হয়ে যান। কিন্তু প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১৬ সালে প্রথম নিয়োগ পান নেপালের সুশিলা কারকি। তিনি দেশটি নারী প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবি ভা-ারি ও নারী স্পিকার অনসারি ঘারতি মাগারের পর এই নিয়োগ পান। বিশ্বের প্রথম নারী স্পিকার হন ন্যান্সি ডি আলেসান্ড্রো পেলসি। তিনি ২০০৭ সালে স্পীকার হয়েছেন। কিন্তু বিশ্বের প্রথম মুসলিম নারী স্পিকার হলেন মুখেরেম আরাস। জার্মানির একটি প্রদেশে তিনি স্পিকার নির্বাচিত হন।
পক্ষান্তরে বিশ্বের কয়েকটি দেশের পার্লামেন্টে দেখা যায় নারী আধিক্য। এরমধ্যে রুয়ান্ডা পার্লামেন্টে ৬৪ জন, বলিভিয়ার পার্লামেন্টে ৫৩ জন, এ্যান্ডোরার পার্লামেন্টে ৫০ জন এবং কিউবার পার্লামেন্টে ৪৯ জন নারী সদস্য রয়েছেন।
শুধু ক্ষমতায়ন নয়, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য নারীরা পেয়েছেন নোবেল পুরস্কারও। পদার্থ বিজ্ঞানে অবদানের জন্য মারি এসক্লোডোকা যৌথভাবে নোবেল পান কারি পিয়ারে কারি ও হেনরি ব্যাকুয়েলের সঙ্গে। শান্তিতে প্রথম নোবেল পান বার্থা ভন সাটনার ১৯০৫ সালে। সাহিত্যে প্রথম নোবেল পান সেলমা ল্যাগারলফ ১৯০৯ সালে। রসায়নে ১৯১১ সালে নোবেল পান মারি এসক্লোডোকা কারি। মানবতার সেবায় জীবন উৎসর্গ করা মাদার তেরেসা ১৯৭৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। নারী শিক্ষা আন্দোলনের জন্য তালেবানের গুলি খাওয়া পাকিস্তানের মালালা ইউসুফ জাইও নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
বিশ্বের প্রথম নারী বৈমানিক হলেন যুক্তরাষ্ট্রের আমেলিয়া মে ইয়ার হার্ট। তিনি এককভাবেই প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দেন। এজন্য তাকে ডিসটিনগুইশড ফ্লাই ক্রস-এ ভূষিত করা হয়। তার জন্ম কানসাসের আটসিসনে।
বিশ্বের প্রথম নারী আইজিপি বিবেচনা করা হয় ভারতের কিরণ বেদীকে। তার জন্ম স্থান অমৃতসরে। তার দাপটের মুখে ভারতের অন্ধকার জগতের তৎপরতা অনেকটাই কমে এসেছিল। তাকে নিয়ে একাধিক চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে।
হ্যামিলটনের আন্তরিওতে জন্ম নেওয়া ফ্লোরেন্স লরেন্সকে চলচ্চিত্রের প্রথম নায়িকা ধরা হয়। কানাডিয়ান-আমেরিকান মঞ্চের সাড়া জাগানো এই অভিনেত্রীর প্রথম ছবি দি অটোমোবাইল থিভস। ছবিটি ১৯০৬ সালে মুক্তি পায়। কিন্তু প্রথম নারী নির্মাতা হিসেবে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পান ক্যাথরিন বিগেলো। তিনি খুব খরচে ইরাক যুদ্ধ নিয়ে নির্মাণ করেন দি হার্ট লকার। একটি বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলকে নিয়ে ছবিটি নির্মিত হয়েছে।
নারী নেতৃত্বের সর্বশেষ উদাহরণ হলেন ব্রাজিলের দিলমা রুসেফ, দক্ষিণ কোরিয়ার জিওন হাই পার্ক এবং থাইল্যান্ডের ইনলাক সিনাওয়াত্রা। কিন্তু এই তিন নারীই দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। সম্পাদনা: রাশিদ