জিডিপিতে ২০ শতাংশ অর্থনীতিতে নারীর অবদান বাড়ছে
হাসান আরিফ : ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার সত্য যখন অর্থনীতির গবেষণায় প্রতিফলিত হয়, তখন বিস্মিত হতে হয় বৈকি! বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলধারার কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অবদান বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ি ১ কোটি ৬৮ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা অর্থনীতির বৃহত্তর এই তিন খাতে কাজ করছেন। অর্থনীতিতে নারীর আরেকটি বড় সাফল্য হলো, উৎপাদনব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। বর্তমানে জিডিপিতে নারীর অবদান ২০ শতাংশ। সমীক্ষা অনুযায়ি, মূলধারার অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃত উৎপাদন খাতের মোট কর্মীর প্রায় অর্ধেকই এখন নারী। এ খাতে ৫০ লাখ ১৫ হাজার নারী-পুরুষ কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে নারী ২২ লাখ ১৭ হাজার। তবে নারী কর্মীদের সিংহভাগই শ্রমজীবী। বাকিদের মধ্যে কেউ উদ্যোক্তা, কেউ চিকিৎসক, প্রকৌশলী। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ নির্বাহী ও উচ্চপদেও দায়িত্ব পালন করছেন তারা।
শ্রমবাজার নিয়ে বিবিএসের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১০ সালে দেশের ১ কোটি ৬২ লাখ নারী কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০১৩ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৬৮ লাখে। প্রতিবছর গড়ে দুই লাখ যুক্ত হচ্ছেন।
বিবিএস এর হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে কৃষি খাতে নিয়েজিত আছেন ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী। এ ছাড়া শিল্প ও সেবা খাতে কাজ করেন যথাক্রমে ৪০ লাখ ৯০ হাজার এবং ৩৭ লাখ নারী। দেশের কলকারখানায় পুরুষের চেয়ে এক লাখ বেশি নারী শ্রমিক কাজ করেন। ভিত্তি বছরের হিসাব অনুযায়ি কারখানায় ২১ লাখ ১ হাজার ৮৩০ জন নারী শ্রমিক রয়েছেন আর পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা ১৯ লাখ ৯৫ হাজার ৫৫৭ জন।
গত এক যুগে বাংলাদেশে কৃষির নারীকরণ হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মতোই দেশের কৃষি খাতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এখন নারীরা। বিবিএসের তথ্য হলো গত ১০ বছরে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০৮ শতাংশ। আর পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে দুই শতাংশ।
খাদ্যনীতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) ২০১৫ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৯০ শতাংশ বাড়িতে মুরগি পালন নিয়ন্ত্রণ করেন নারী। ছাগল ও গরু পালনে নারীদের নিয়ন্ত্রণ ৫৫ শতাংশ। কুমড়া ও লাউচাষিদের ৪২ শতাংশ ও টমেটো চাষিদের ৩৮ শতাংশ নারী। ধান কাটা ও রোপণের ক্ষেত্রে নারীদের তেমন অংশগ্রহণ না থাকলেও জরিপ অনুযায়ী ধান মাড়াই, শুকানো, সংগ্রহ ও বীজ সংরক্ষণের ৫৮ থেকে ৭১ শতাংশই নারীর ওপর নির্ভরশীল। কৃষিতে নারীর এই নেতৃত্বের কারণে দেশের পরিবার ও শিশুদের পুষ্টি পরিস্থিতিরও উন্নতি হচ্ছে।
এফপ্রির পুষ্টি ও কৃষিতে নারী শীর্ষক আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা তাঁদের আয়ের ৭০ থেকে ৯০ শতাংশই ব্যয় করছেন পরিবারের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায়। আর পুরুষদের এ ক্ষেত্রে ব্যয় মোট আয়ের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ।
রপ্তানিমুখী শিল্পে নারী শ্রমিকের চাহিদা ও অংশগ্রহণ বেশি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক শিল্প, হিমায়িত চিংড়ি, চামড়া, হস্তশিল্পজাত দ্রব্য, চা ও তামাক শিল্পসহ অন্যান্য পণ্য। মোট রপ্তানি আয়ের ৭৫ ভাগ অর্জনকারী শিল্পের মূল চালিকাশক্তি নারী। পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত চার মিলিয়ন বা ৪০ লাখ কর্মীর মধ্যে ৮০ ভাগই নারী।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকদের গ্রাম ও শহুরে অর্থনীতিতে অবদান শীর্ষক এক গবেষণায (২০১৩) দেখিয়েছেন যে, পোশাকশিল্পের নারী কর্মীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ শেষে লিপস্টিক, পাউডার, সালোয়ার-কামিজ বা শাড়ি, স্যান্ডেল, মোবাইল ফোন এমনকি বিউটি পারলারের পেছনে সাধ্যমতো খরচ করছেন। ফলে বাজার অর্থনীতিতে নতুন নতুন চাহিদার সৃষ্টি হচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্রমতে, রাজধানীতে বিউটি পারলারে কাজ করেন প্রায় পাঁচ হাজার গারো মেয়ে। গারো আদিবাসীদের সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে পোশাকশিল্পে আদিবাসী কর্মীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার, যাঁদের ৬৫ শতাংশই নারী। সাভার ইপিজেড এলাকায় আদিবাসী কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার যার ৭০ শতাংশই নারী।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছে, অর্থনীতিতে অতিদ্রুত বিশেষ করে চাকরি, ব্যবসায় নারীর সংখ্যা বাড়ছে। মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ১৯৯৫-৯৬ সালে ১৫.৮ শতাংশ, ২০০২-০৩ সালে ২৬.১ শতাংশ, ২০০৫-০৬ সালে ২৯.২ শতাংশ এবং ২০১১-১২ সালে ৩৯.১ শতাংশ।
বিবিএসের সময় ব্যবহার’ জরিপে দেখা গেছে, কর্মজীবী একজন পুরুষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্থের বিনিময়ে ৬ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট কাজ করেন। আর নারীরা ৫ ঘণ্টা ১২ মিনিট কাজ করেন। তবে একজন কর্মজীবী নারী বাসায় এসে দৈনিক গড়ে ৩ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট গৃহস্থালির কাজ করেন। আর পুরুষেরা ঘরের কাজে গড়ে মাত্র ১ ঘণ্টা ২৪ মিনিট সময় ব্যয় করেন।
বাংলাদেশে ১ কোটি ৬ লাখ লোক গৃহস্থালির কাজ করেন। তাঁদের সিংহভাগই নারী। এছাড়া রয়েছে গৃহকর্মী।
বিবিএসের সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে স্থায়ী কিংবা অস্থায়ীভাবে নয় লাখ নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। যা জিডিপির অন্তর্ভূক্ত নয়।
সিপিডি ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১২ দশমিক ১টি কাজ করেন, যা জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। অন্যদিকে পুরুষের ক্ষেত্রে এ ধরনের কাজের সংখ্যা মাত্র ২ দশমিক ৭।
বাংলাদেশ প্রেক্ষিত শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব একজন নারী গড়ে প্রতিদিন একই বয়সের পুরুষের তুলনায় প্রায় তিন গুণ সময় কাজ করেন।
সিপিডির ড. ফাহমিদা খাতুন এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, গৃহস্থালিতে নারীর যে কাজ জিডিপিতে অন্তর্ভূক্ত হয় না সেই শ্রমের প্রাক্কলিত বার্ষিক মূল্য (২০১৩-১৪ অথর্বছর) জিডিপির ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আবুল বারকাত দেখিয়েছেন গৃহস্থালি কাজে সারা দেশের নারীরা বছরে ১৬ হাজার ৬৪১ কোটি ঘণ্টা সময় ব্যয় করছেন, যার আর্থিক মূল্যমান দুই লাখ ৪৯ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। জিডিপিতে এই আর্থিক মূল্য যোগ হলে নারীর হিস্যা বর্তমানের ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের নারীরা। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সালের জুনে এ দেশে ক্ষুদ্রঋণের গ্রাহকের সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার। এর ৯০ শতাংশই নারী গ্রাহক।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, দেশের মোট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের ৩৫ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা। ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৮৬০ মিলিয়ন ডলার ৫৭ হাজার ৭২২ জন নারীকে ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এতে তারা গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ৯৭ থেকে ৯৯ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাই ব্যাংক থেকে জামানতবিহীন ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করেন, যা একটি বিরাট সাফল্য।
দেশের গন্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ২০ থেকে ৩০ হাজার নারীকর্মী বিদেশে যাচ্ছেন। শ্রমকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মোট অভিবাসী শ্রমিকের ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ নারী, যারা তাদের আয়ের প্রায় ৭২ শতাংশই দেশে পাঠিয়ে থাকেন।
এ বিষয়ে বিআইডিএসের ফেলো ড. এম আসাদুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অবদান ৫৩ শতাংশ। এর বিপরীতে পুরুষের অবদান ৪৭ শতাংশ। এরপরও রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীর স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন নেই। রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার অংশ হিসেবে ২০১৫ সালে ১ কোটি ৩৯ লাখ কৃষক কার্ড বিতরণ করা হলেও নারী কৃষকদের ভাগ্যে তা জোটেনি। তা ছাড়া নারী কৃষিশ্রমিকের প্রতি মজুরিবৈষম্য এখনো অব্যাহত আছে। অথচ নারী শ্রমশক্তির ৬৮ শতাংশই কৃষি উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িত।
নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, বিদ্যমান সমাজকাঠামো, প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কৃষিতে নারীর অবদানকে অবহেলা করার সাধারণ প্রবণতা থেকেই কৃষিতে নারীর অবদান স্বীকৃতি পাচ্ছে না।
অক্সফামের জ্যেষ্ঠ নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা মেহবুবা ইয়াসমীন বলেন, কৃষিতে গ্রামীণ নারীর অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া ও উপযুক্ত সম্মান জানানোর সময় এসেছে এখন। গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়ন ছাড়া দেশ থেকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য ঘোচানোর চেষ্টা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সম্পাদনা: রাশিদ