ভুয়া সংবাদ প্রতিরোধে লাইব্রেরি এবং সংবাদ সংস্থা
মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে:
‘ফ্যাক্ট’ ও ‘ফিকশন’ নির্ভর বিশ্বে গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দ্রুত বিস্তৃতি পেয়েছে। ফলে কোনটি সত্য কিংবা সত্যের অপলাপ অথবা সত্যের বৈপরীত্যসূচক কল্পনা বা বানোয়াট বিষয়বস্তু, তা বোঝাটা দুরূহ হয়েছে।
তাই গত বছর সর্বাধিক ব্যবহৃত ইংরেজি ‘পোস্ট-ট্রুথ’ বা সত্যোত্তর শব্দটি অক্সফোর্ড ডিকশোনারিতে স্থান পেয়েছে। সেজন্য কানাডার অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্রে অতি সুবিন্যস্ত ও ব্যস্ততম আয়োজনে শহরময় ১০০টি শাখায় গড়া টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরি ইন্টারনেট ব্যবহারের জননিরাপত্তায় গতকাল একটি গাইড অনলাইনে দিয়েছে, যাতে ভুয়া সংবাদ নিরূপণ সহজ হয়। কেননা অবাধ তথ্য প্রবাহের সঙ্গে শুধু যে ভুল তথ্য আসছে তা নয়, বরং ভ্রান্তিপূর্ণ তথ্যও জেঁকে বসেছে। এ বিষয়ে টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরির বদ্ধমূল ধারণা তাদের প্রায় ১ কোটি ৯ লাখ নিয়মিত পাঠক বা গ্রাহক সত্যানুসন্ধানে বছরে অন্তত ৩ কোটি ২০ লাখ বই ও অপরাপর জ্ঞানার্জনমূলক সামগ্রী ধার নেন। সে কারণে তথ্য সমৃদ্ধ ডিজিটাল বিশ্বে সুচিন্তিত প্রয়াস ও গবেষণায় ওই লাইব্রেরি ব্যবস্থাটি তার বিনামূল্যের পাঠক সদস্যদের সহযোগিতা প্রদানে উদ্যোগী হয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বহুবিধ লাইব্রেরি ব্যবস্থাও এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য মনোনিবেশ করেছে।
এক্ষেত্রে ভুয়া সংবাদ বা নিবন্ধ নিরূপণে লেখকের নাম, যোগ্যতা, প্রকাশকের পরিচিতি, একই বিষয়ে অপরাপর নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের প্রকাশনা তুলনা ও প্রাথমিক উৎসে তা প্রকাশের মাহাত্ম্য বিবেচনাটি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে বুঝতে হবে একটি সংবাদ সত্য ঘটনাবলির নানা দিক তুলে ধরে। যদি তা বিতর্কের একটি মাত্র দিক তুলে ধরে, তাহলে পাঠককে বুঝতে হবে তা পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়, বরং পক্ষপাতিত্বের অন্ধত্বপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ। এছাড়া ওই গাইড বা নির্দেশিকায় সামাজিক ও গণমাধ্যমকে তুলনা করে বলা হয়েছেÑ সচরাচর গণমাধ্যম কঠোর নিয়মনীতিতে চলে বিধায় তাদের ব্রেকিং নিউজসহ মতামত ও আলোচনাগুলো অনলাইনে থাকে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ও ফটো যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই; ফটো যাচাইয়ে চাই ‘গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ’। তথাপি গাইডে তথ্য যাচাই-বাছাইয়ে নির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইট হিসেবে ফ্যাক্টচেকডটঅর্গ, পলিটিফ্যাক্ট, মিডিয়াবায়াসফ্যাক্টচেক, স্নোপস, ট্রুথঅরফিকশনডটকম, হোক্সি, বিএসডিটেক্টরডটটেক-কে উল্লেখ করেছে। একইভাবে টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরির রিসোর্স হিসেবে বই, ই-বুক ও ই-ভিডিও যাচাইয়ে রয়েছে পাঁচটি অনলাইন উপায়ান্তর; এমনকি আগাম নোটিসে অভিজ্ঞ লাইব্রেরিয়ানের তত্ত্বাবধানে ৩০-৬০ মিনিটের পরামর্শ পাবার সুযোগ। এছাড়া অতিরিক্ত গবেষণা কর্মের জন্য রয়েছে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি, যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও গুস্তাভাস অ্যাডলফাস কলেজের ‘ফাইটিং ফেইক নিউজ’ বা ভুয়া সংবাদ প্রতিরোধের উৎসসমূহ।
আশার বাণীটি হচ্ছে, বিশ্বে এই প্রথম আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম হিসেবে ‘বিবিসি’ বা ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন সম্প্রতি তাদের ‘বিবিসি একাডেমি’র বিশেষ পর্যবেক্ষণে ‘ফেইক নিউজ’ প্রতিরোধে অগ্রবর্তী হয়েছে। তাদের মিডিয়া এডিটর আমল রাজান, ‘বাজফিড’ নিউজের বিশেষ প্রতিনিধি জেমস বল এবং ‘সোশ্যাল মিডিয়া’ এডিটর মার্ক ফ্রাঙ্কেল একে অপরের সহযোগী হয়েছেন। অন্যদিকে চলতি মার্চের শুরুতে অনলাইন সার্চ ইঞ্জিন ‘গুগল’-এর সহায়তায় ফ্রান্সের বার্তা সংস্থা এএফপি, ডেইলি ‘লি মন্ড’, ‘লিবারেশন’, বিবিসি নিউজ, চ্যানেল ফোর ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্লুমবার্গসহ মোট ৩৭টি গণমাধ্যম একত্রে ‘ফেইক নিউজ’ প্রতিরোধে ‘ক্রসচেক’ নামক একটি ওয়েবসাইটের শরণাপন্ন হতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে।
ভাবছি! বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোও কী ভুয়া সংবাদ প্রতিরোধে তেমন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসবে, যাতে টরন্টোর ভুঁইফোড় কোনো ওয়েব পোর্টালের রাষ্ট্রীয় সংবাদ পরিবেশনায় দায়িত্বশীল হয়েই কানাডার দূতাবাসকে যাচাই করা হবে; যাতে জনগণের কাছে সংবাদের মৌলিক গুরুত্ব বা ‘নিউজ ভ্যালু’ প্রচারণা বা ‘এডভার্টাইজিংয়ে’ বিলীন না হয়।
ইমেইল: নঁশযধৎর.ঃড়ৎড়হঃড়@মসধরষ.পড়স