হাদিসগ্রন্থ সুনানে আবু দাউদের পরিচিতি
মুফতী আজীজুল্লাহ আশরাফ
হিজরী বর্ষ ২০২। আব্বাসী খেলাফতের দাপটের রাজত্ব তখন দুনিয়াজুড়ে। রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা তখন স্বপ্ন ছুঁয়েছে। বিশেষ করে ‘ইলমে হাদীস’ চর্চা তখন উৎকর্ষতার স্বর্ণশিখরে। এমনই সময়ে কান্দাহারের কাছাকাছি আফগানিস্তানের সিজিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন ইমাম আবু দাউদ। মূলনাম সুলাইমান। (সুলাইমান ইবনে আশ’আছ ইবনে ইসহাক ইবনে বশীর ইবনে শাদ্দাদ আস্ সিজিস্তানী। ) খানিক বড় হতেই পরিবেশের দাবি মেনে নিয়ে হাদীস শাস্ত্রের সাথেই গড়ে ওঠে তার সখ্যতা। সময়ের আবর্তে এ সখ্যতা তার নেশা হয়ে দাড়ায়। তাই এ শাস্ত্রে উন্নতির লক্ষে তিনি সমকালীন বিখ্যাত বহু হাদীস-পন্ডিতের সান্যিধ্য নিয়েছেন। ভ্রমন করেছেন বহু রাষ্ট্র। বর্ণিত আছে, কেবল হাদীস শাস্ত্রেই তার গুরুজনের সংখ্যা তিনশ’র অধিক। তাদের মধ্যে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইয়াহয়া ইবনে মায়ীন, ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ, উসমান ইবনে আবী শায়বা সহ রয়েছেন আরো অনেক কালজয়ী মুহাদ্দিস; যাদের অনেকে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের শিক্ষাগুরুও বটে।
এভাবে একসময় ইমাম আবু দাউদ হয়ে ওঠেন একজন শাস্ত্রজ্ঞ, বিদগ্ধ মনীষী। হাফিজুল হাদীস ইব্রাহীম হারবী বলেন: ইমাম আবু দাউদের হাতে হাদীস শাস্ত্রকে এতটা নরম করে দেয়া হয়েছে যতটা নরম করে দেয়া হয়েছিল লোহাকে নবী দাউদ আ. এর হাতে। তিনি ফেকাহ শাস্ত্রেও সমান দক্ষ ছিলেন। এদুভয় শাস্ত্রকে মিলিয়ে এবার তিনি পৃথিবীকে পরিচিত করালেন হাদীস জগতের নতুন এক অধ্যায়ের সাথে। তিনিই প্রথম ‘সুনান’ রীতি উদ্ভাবন করে ‘ফিকহী তারতীবে’ হাদীস-গ্রন্থের অধ্যায় বিন্যাস করেন। অর্থাৎ মানুষের ব্যবহারিক জীবনের যাবতীয় কর্মকান্ডের বিধান বর্ণনাকে প্রাধান্য দিয়ে গুরুত্বের বিচারে তিনি সূচি নির্মাণ করেছেন। প্রথমে নামাজ, তারপর যাকাত, তারপর রোযা… এভাবে প্রথমে ধর্ম সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি, এরপর ইহজগত সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি যেমন লেনদেন ও অন্যান্য সব বিষয়ের বিধান সম্বলিত হাদীস এনেছেন। উক্ত বিন্যাসরীতি অনুস্বরণ করে সংকলিত হাদীস গ্রন্থকে ‘সুনান’ বলে। সুনানে নাসাঈ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ এ ধারারই পরবর্তী সংকলন। এ ধারার প্রবর্তক হলেন ইমাম আবু দাউদ। এ রীতির প্রথম গ্রন্থ ‘আস্ সুনান লি আবী দাউদ’। সিহাহ সিত্তায় চতুর্থ অবস্থানে থাকা হাদীসের এ গ্রন্থটি হাম্বলী মাযহাবের অনুস্বারীদের অত্যন্ত আপন বলে অন্যান্য মাযহাবধারীদের কাছে তা গুরুত্বহীন তা নয়। বরং মাযহাব-বিভিন্নতার উর্দ্ধে উঠে সকল মাযহাবীদের আগ্রহ আকর্ষণ করতে সমান সক্ষম হয়েছে গ্রন্থটি। ইমাম আবু দাউদ তার নিকট সংরক্ষিত পাঁচ লক্ষ হাদীস থেকে ছেটে-বেছে প্রায় পাঁচ হাজার হাদীস দিয়ে তৈরি করেছেন সংকলনটি। এর সকল হাদীস আমলযোগ্য।
সর্বসম্মত ‘মাতরুক’ কোন বর্ণনা এ গ্রন্থে স্থান পায়নি। এর সব হাদীস সহীহ ও হাসান পর্যায়ের। প্রয়োজনের বিশেষ মুহূর্তে দুর্বল কিছু বর্ণনা আনলেও তিনি তার অব্যবহিতেই দুর্বলতা বা দুর্বলতার কারণ স্পষ্ট করে দিয়েছেন। সব মিলিয়ে সুনানে আবু দাউদ ইমাম আবু দাউদের দক্ষ হাতে তৈরি এমন একটি সংকলন, যার উপমা আগে-পরে কখনোই আসেনি। তথ্যসূত্র: তাযকিরাতুল হুফফাজ, বাজলুল মাজহুদ, মুকাদ্দামাতু সুনানি আবী দাউদ, হালাতুল মুসান্নিফীন।