টাকা ফেরত দিতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক তবে সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জমা হওয়া টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক ফেরত দিতে চাইছে। তবে টাকা কোন পন্থায় ফেরত দিবে তা সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক আপিল বিভাগের বায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করবে কিনা এ ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছে সেই রায় অনুযায়ী আমরা টাকা ফেরত দেব। টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত জানতে হবে। সরকার কোন প্রক্রিয়াতে টাকা ফেরত দিতে চায়। সরকার যেভাবে বলবে সেভাবে টাকা ফেরত দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে ওই সময়ে যে হিসাবে ১২০০ কোটি টাকা জমা করা হয়েছিল ওই টাকা আছে নাকি অন্য কোনো খাতে খরচ করা হয়েছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১২০০ কোটি টাকা আছে। টাকা খরচ হয়েছে বলে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। টাকা কবে নাগাদ ফেরত দেওয়া শুরু হবে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বলেন, টাকা ফেরতের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলেই এককভাবে ফেরত দিতে পারবে না। এই জন্য সরকারকে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে। ওই টাকা কি সরকার কোনো খাতে খরচ করেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা এখনই আমি বলতে পারব না। এটা সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলতে পারবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়ে আপিল খারিজ করে দেওয়ার পর এখন পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। রায়ের কপি পেলে এরপর রিভিউ করবে। রিভিউর আদেশ না আশা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ-এর রায়ের ফলে ৬১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ফেরত দিতে হাইকোর্টের রায়ই বহাল রয়েছে।
রায়ের পর ১২০০ কোটি টাকার আংশিক ফেরত পেলেও বাকিরা এখনই টাকা ফেরত পাচ্ছে না। রায়ের পর রিট আবেদনকারীদের পক্ষের আইনজীবী আহসানুল করীম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, যারা মামলা করেছেন তারাই টাকা ফেরত পাবেন। টাকা কবে কিভাবে দেওয়া হবে তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ থাকবে।
এর আগে হাইকোর্ট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নেয়া ১২০০ কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার আদেশ দিয়েছিল। দুটি আদেশের একটি হয়েছিল ২০১০ সালে আর একটি ২০১১ সালে। ওই আদেশের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক আপিল করে। ওই আপিলের শুনানি শেষে তা খারিজ করে দেয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০০৮ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ওই সময়ে সরকারের নির্দেশে প্রায় ৪০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ১২০০ কোটি টাকা দুইশতাধিক পে-অর্ডারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে ০৯০০ নম্বর হিসাবে জমা হয়। ওই হিসাবটি সরকারি হিসাব বলেও জানা গেছে। ওই সময়ে যেসব গ্রুপের ও ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে এরমধ্যে জেমস ফিনলে ১১৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা ১৬টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ‘কনসোলিটেড ফান্ডে’ জমা দেওয়া হয়। একই প্রতিষ্ঠানের নামে আরও ১৫টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ১২০ কোটি ২৪ লাখ টাকা জমা হয়।
ওই ব্যাংক হিসাবে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পরিচয় ছাড়াও অজানা উল্লেখ করেও ওই ব্যাংক হিসাবে চার দফায় আরও ৪৭ কোটি টাকা জমা করা হয়।
জানা গেছে, ওই সময়ে যারা টাকা জমা দেন এরমধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপের কাছ থেকে ২৫৬ কোটি টাকা, সিকদার গ্রুপের পরিচালক ও সদস্যদের পক্ষ থেকে পারভীন হক সিকদার পে-অর্ডারের মাধ্যমে ৪২ কোটি টাকা জমা করেন। যমুনা গ্রুপ ৩০ কোটি, এমজিএইচ গ্রুপ ২৪ কোটি, বিএনপির সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ২০ কোটি, কবির স্টিল মিলস সাত কোটি, নুর আলী ৪০ কোটি ৫০ লাখ, আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন ৩২ কোটি ৫০ লাখ, সাগুফতা হাউজিং দুই কোটি ৫০ লাখ, হোসাফ গ্রুপ ১৫ কোটি, পারটেক্স গ্রুপ ১৫ কোটি, স্বদেশ প্রোপার্টিজ নয় কোটি, ইসলাম গ্রুপ ৩৫ কোটি, কনকর্ড ইঞ্জিনিয়ারিং আট কোটি, ব্যবসায়ী রেজাউল করিম ১৭ কোটি, আবু সুফিয়ান ১৪ কোটি, শওকত আলী চৌধুরী ছয় কোটি, আশিয়ান সিটি এক কোটি, পিংক সিটি ছয় কোটি ৪১ লাখ, বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এসোসিয়েশন ১৯ কোটি ৪৫ লাখ, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ১৫ কোটি, ওয়াকিল আহমেদ ১৬ কোটি, এবি ব্যাংক ফাউন্ডেশন ৩২ কোটি, গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ২০ কোটি ৪১ লাখ, এলিট পেইন্ট ২৫ কোটি ৪৪ লাখ, এবি ব্যাংক ১৯০ কোটি, কনকর্ড রিয়েল এস্টেট সাত কোটি ও জনৈক মালিকের কাছ থেকে চার কোটি এবং আবদুল আউয়াল মিন্টুর দুই কোটি ২০ লাখ টাকা জমা হয়। অভিযোগ রয়েছে, তাদেরকে ওই সব হিসাবে টাকা জমা করার জন্য বাধ্য করা হয়। এই জন্য তারা ওই সময়ে নিজেরা মামলা থেকে বাঁচতে ও সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই হিসাবে টাকা জমা করেন।