২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ শিক্ষকসহ দুই শতাধিক ছাত্র-কর্মচারী হত্যা করে পাকবাহিনী
উম্মুল ওয়ারা সুইটি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. অজয় রায় ১৯৭১ সালের কালো রাতের ঘটনার স্মৃতি চারণ করে আরো বলেন, অসহযোগ আন্দোলন মূলত গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহরুল হক হলের “স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন পরিষদকে কেন্দ্র করে। তাই, পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম লক্ষ্য ছিলো এই হলটি। এই হলের কম-বেশি ২০০ জন ছাত্রকে পাকবাহিনী হত্যা করেছিল। তিনি বলেন, যারা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল তাদের বিচার হচ্ছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাযৃক্রম অবিলম্বে সম্পন্ন করতে হবে। আজ একাত্তুরের পরাজিত শক্তি আইএসআই ও আইস এস -এর সহায়তায় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংষ করার গভীর চক্রান্ত শুরু করেছে। আন্দোলনের নামে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করছে। যা পাকিস্তানী বর্বরবাহিনী ১৯৭১ সালে করেছিল আজ দেশে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের দাবির নামে সেই একই কায়দায় যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে শিশু ও নারীসহ সাধারণ মানুষকে তারা হত্যা করছে। তারা মুলত: দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত ও ধ্বংষ করতে চায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে এ তথ্য জানা যায়, ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বর্বর পাকবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই নির্মম গণহত্যার স্মৃতি ও বেদনার ঘটনা আজো তাড়িয়ে বেড়ায় গোটা দেশবাসীকে উত্তাল পঁচিশে মার্চের এই দিনে। এতে বলা হয়,অপারেশন সার্চলাইট নামে ২৫ মার্চ ১৯৭১ -এর গণহত্যার রাতে সমগ্র ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয়। বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকটি সুসজ্জিত দল ঢাকার রাস্তায় নেমে প্রথমে ঢুকে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলো ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বেলুচ, ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং কিছু সহযোগী ব্যাটেলিয়ান। এই বাহিনীগুলোর অস্ত্রসম্ভারের মাঝে ছিলো ট্যাংক, স্বয়ংক্রীয় রাইফেল, রকেট নিক্ষেপক, ভারী মর্টার, হালকা মেশিনগান ইত্যাদি। এ সব সমস্ত অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্থানী বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। ইউনিট নং ৪১ পূর্ব দিক থেকে, ইউনিট নং ৮৮ দক্ষিণ দিক থেকে এবং ইউনিট নং ২৬ উত্তর দিকে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ফেলেছিল।
অধ্যাপক আনোয়ার পাশার উপন্যাস ‘রাইফেল, রোটি, অওরাত” থেকে জানা যায, ২৫ মার্চের প্রথম প্রহরে অধ্যাপক ফজলুর রহমান এবং তার দুই আত্মীয় নীলক্ষেতের ২৩ নং ভবনে নিহত হন। তার স্ত্রী দেশের বাইরে অবস্থানের কারণে বেঁচে যান। পাকবাহিনী অধ্যাপক আনোয়ার পাশা এবং অধ্যাপক রশিদুল হাসানের (ইংরেজি বিভাগ) বাসভবন আক্রমণ করেছিল। তারা দুজনেই খাটের নিচে লুকিয়ে বেঁচে যান। কিন্তু পরবর্তীতে আল-বদর বাহিনীর হাতে তারা প্রাণ হারান। ২৪ নং ভবনে বাংলা সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম থাকতেন। তাঁর বাসভবনে প্রবেশমুখে দুইজন আহত নারী তাদের সস্তানসহ কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের রক্তের দাগ লেগে ছিলো মাটিতে। পাকবাহিনী যখন তার বাসভবন আক্রমণের জন্য আসে, তখন তারা রক্তের দাগ দেখে ধারণা করে নেয় অন্য কোন ইউনিট হয়তো এখানে হত্যাযজ্ঞ কাজ সমাধা করে গেছে। তাই তারা আর প্রবেশ করেনি। এভাবে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম নিতান্ত ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। পরবর্তীকালে তিনি জানান যে, ওই ভবনে আরও একজন পূর্ব-পাকিস্তানী অধ্যাপক বাস করতেন, যিনি ২৫ মার্চের আগেই ঘর ছেড়ে যান। অন্যসব বাসায় অবাঙ্গালী কিছু পরিবার থাকতো, যারা অন্যদের কিছু না জানিয়েই ঘর ছেড়ে অন্যত্র সরে যায়।
১২ নং ফুলার রোডের বাসভবনে পাকিস্তানী আর্মি সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সায়েদ আলী নোকির বাসায় যায়। পাক সেনারা তাকে ছেড়ে দিলেও ওই একই ভবনের ভূ-তত্ত্ববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল মুক্তাদিরকে হত্যা করে। তার মৃতদেহ জহরুল হক হলে (তদানীন্তন ইকবাল হল) পাওয় যায়। পরে তার আত্মীয়রা তাকে পল্টনে সমাহিত করেন। ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক মুনিম, যিনি সেই সময় সলিমুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের দায়িত্বে ছিলেন। পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণে তিনি আহত হন।
তখন ঢাকা হলের গণিত বিভাগের অধ্যাপক আ র খান খাদিম ও শরাফত আলীকে হত্যা করা হয়। পাকিনী বাহিনী জগন্নাথ হলে শিক্ষকনিবাস আক্রমণ করে এবং অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মির্জা হুদা ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মফিজুল্লাহ কবিরকে লাঞ্ছিত করেছিল।
তৎকালীন সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাত্রদের আবাস জগন্নাথ হল আক্রমণের সময় হলের প্রভোস্টের বাসাও আক্রমণ করা হয়। পাকিস্তানী বাহিনী ভূতপূর্ব-প্রভোস্ট এবং জনপ্রিয় শিক্ষক, দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক জি সি দেবকে হত্যা করে। তার সংগে তার মুসলিম দত্তক কন্যার স্বামীকেও। এর পর পাকিস্তানী বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী বাসভবনে আক্রমণ করে এবং সেখানে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড মনিরুজ্জামানকে তার পুত্র ও আত্মীয়সহ হত্যা করে। জগন্নাথ হলে প্রভোস্ট অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে মারাত্মকভাবে আহত হন এবং পরে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকেরা অধ্যাপক ঠাকুরতাকে চিনতে পারেন। কলেজের মর্গের কাছে একটি গাছের নিচে তাক সমাহিত করা হয়। জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার সাথে অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকেও হত্যা করা হয়েছিল। সহযোগী হাউস টিউটর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকেও ছাত্রাবাসেই হত্যা করা হয়। অধ্যাপক পাশা পরবর্তীতে ডিসেম্বর মাসে আল-বদর বাহিনীর হাতে নিহত হন বলে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. অজয় রায় জানান।