পাকিস্তানিদের আক্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত হই পুলিশের ওয়ারলেসে একটা ম্যাসেজ ভেসে আসার পর
২৫ মার্চের কালোরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ‘সেই’ প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়া কনস্টেবল শাহজাহান মিয়া
২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিকবাহিনীর বর্বর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স ও ইপিআর। এই তিনটি জায়গায় অনেকটা একই সময় আক্রমণ চালায় পাক সেনারা। সেই সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে সাধারণ পুলিশ সদস্যদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয় পাকিস্তানিদের। হালকা কিছু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভারি অস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর সঙ্গে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে পুলিশ সদস্যরা। অসম সেই যুদ্ধে শহীদ হন কমপক্ষে ১৫০ জন পুলিশ সদস্য। ২৫ মার্চের কালোরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কনস্টেবল শাহজাহান মিয়া। তিনি তখন ওয়ারলেস অপারেটর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। শাহজাহান মিয়ার কাছে জানতে চেয়েছিলাম বিভীষিকাময় সেই রাতের কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিক্ষক ও সাংবাদিক রাহাত মিনহাজ।
প্রশ্ন: ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকে ঢাকা শহরে ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কী পরিস্থিতি ছিল?
শাহাজাহান: ২৫ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকা শহরে ব্যাপক উত্তেজনা। চারদিকে কানাঘুঁষা। ছিল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, বাঙালি সেনা সদস্য, ইপিআর আর পুলিশ সদস্যরা নিশ্চিত ছিল কিছু একটা হতে যাচ্ছে। আর সেই কিছু একটা যে পাকবাহিনীর আক্রমণ বা নিষ্ঠুরতা সে বিষয়ে প্রায় সবাই নিশ্চিত ছিল। বিকেলে ঢাকা শহরে মিছিল হয়েছে। ছাত্র-জনতা সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন রাস্তায় যে যেভাবে পেরেছে ব্যারিকেড দিয়েছে। ওইদিন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সেও ছিল চাপা উত্তেজনা।
প্রশ্ন: আপনারা কি পাকিস্তানিদের আক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন?
শাহাজাহান: ঢাকায় আর্মি নামলে যে রাজারবাগে আক্রমণ হবে সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। ওইদিন রাত সাড়ে আটটার দিকে আমিসহ ৩৫-৪০ জন পুলিশ সদস্য মালিবাগ এলকায় ছিলাম। সেখানে একজন লোক দৌড়ে এসে আমাদেরকে জানায়, পাকিস্তানিরা আজ রাতেই আক্রমণ চালাবে। সেখান থেকে দৌড়ে আমরা রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আসি। আর পাকিস্তানিদের আক্রমণের বিষয়টি আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত হই পুলিশের ওয়ারলেসে একটা ম্যাসেজ ভেসে আসার পর।
প্রশ্ন: ওয়ারলেসে কী ম্যাসেজ এসেছিল?
শাহাজাহান: মালিবাগ থেকে ফিরে আমি ওয়ারলেস স্টেশনে অপেক্ষা করছিলাম। ভাবছিলাম এই বুঝি কোনো জরুরি ম্যাসেজ আসে। অপেক্ষার এক পর্যায়ে আমি একটা বার্তা পাই। বার্তাটি ছিল ‘ঈযধৎষবু ঝবাবহ ভড়ৎ নধংব ধনড়ঁঃ ৩৭ ঃৎঁপশং ষড়ধফবফ রিঃয চধশরংঃধহ ধৎসু ধৎব ঢ়ৎড়পববফবফ ঃড়ধিৎফং উযধশধ পরঃু ভৎড়স ঈধহঃড়হসবহঃ. . .ড়াবৎ’
এই ম্যাসেজ পাওয়ার পর আমি নিশ্চিত হই যে আমরা সত্যিই আক্রান্ত হয়েছি। এরপর আমি ওয়ারলেসের মাধ্যমে সব বেস স্টেশনে ম্যাসেজ পাঠায় ‘ইধংব ভড়ৎ ধষষ ংঃধঃরড়হ ড়ভ ঊধংঃ চধশরংঃধহ চড়ষরপব শববঢ় ষরংঃবহরহম. বি ধৎব ধষৎবধফু ধঃঃধপশবফ নু ঃযব চধশরংঃধহ অৎসু. ঞৎু ঃড় ঝধাব ণড়ঁৎংবষভ.’
প্রশ্ন: সেদিন রাতে রাজারবাগে কতজন পুলিশ ছিলেন? তাদের কাছে কি ধরনের অস্ত্র ছিল?
শাহাজাহান: তখন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে চারটি ব্যারাক ছিল। সে রাতে রিজার্ভ পুলিশসহ আনুমানিক পুলিশ সদস্য ছিলেন ৫০০-৬০০ জন। আর অস্ত্র বলতে আমাদের হাতে ছিল সর্বসাকুল্যে ৩০৩ রাইফেল। যার মাধ্যমে বর্বর পাকিস্তানিদের প্রতিহত করা প্রায় আসম্ভব ছিল।
প্রশ্ন: রাত কয়টার দিকে, কিভাবে পাকিস্তানিরা রাজারবাগ আক্রমণ করল?
শাহাজাহান: শহরের অবস্থা অনুধাবন করে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি ছিল। ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনারা বের হয়েছে এ খবর শুনতে পেয়ে রাত ১০.৩০-এর দিকে রাজারবাগের পাগলা ঘণ্টা বাজানো শুরু হয়। এরপরই পুলিশ সদস্যরা যে যার মতো অবস্থান নিতে থাকে। সে সময় চ্যামেলিবাগে ডন নামের একটা স্কুল ছিল। সে জায়গায় পুলিশ সদস্যরা শক্ত ব্যারিকেড তৈরি করে। পাক সেনারা সেখানে এসেই থেমে যায়। ব্যারিকেড সরানো শুরু করলে পুলিশই প্রথম তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। তখন সময় আনুমানিক ১১টা ৫৫ মিনিট।
প্রশ্ন: যুদ্ধ কতক্ষণ চলল? কেমন ভয়াবহ ছিল সেই যুদ্ধ?
শাহাজাহান: দেখুন, অস্ত্র হালকা হলেও আমাদের পজিশন ভালো ছিল। তাই প্রথমদিকে পাক সেনারা কিছুটা ব্যাকফুটে ছিল। কিন্তু তাদের কাছে ছিল ভারি অস্ত্র। আর যেহেতু আমাদের পুলিশ ভাইয়েরা বিভিন্ন ভবনের উপরে অবস্থান নিয়েছে, তাই পাকিস্তানিরা ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। তারা পুলিশের ব্যারাক ও বিভিন্ন ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে প্রচ- তাপ তৈরি হয়। যার ফলে উপরে অবস্থান নেওয়া পুলিশরা নিচে নামতে বাধ্য হয় বা অনেকেই প্রাণ হারান। আর মর্টারসহ অন্যান্য ভারি অস্ত্র ব্যবহার করায় পাকিস্তানিদের সামনে টেকা সম্ভব হয়নি। যাই হোক, অসম এক যুদ্ধ শেষে রাত তিনটার দিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের নিয়ন্ত্রণ নেয় পাক সেনাবাহিনী।
প্রশ্ন: সেই যুদ্ধে কতজন অকুতোভয় পুলিশ সদস্য প্রাণ হারান?
শাহাজাহান: আসলে ওই রাতে কতজন প্রাণ হারান আর কতজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন তার ঠিক হিসাব আমরা তৎক্ষণাত পাইনি। যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে আমরা যে হিসাবে পেয়েছিলাম তাতে সেই রাতে রাজারবাগে অন্তত ১৫০ পুলিশ সদস্য শাহাদৎবরণ করেন।
প্রশ্ন: আপনিও ওই রাতে আটক হন। সেখান থেকে আপনি পালালেন কিভাবে?
শাহাজাহান: ২৫ মার্চ রাতের ওই যুদ্ধে আমি আহত হয়েছিলাম। পরে আমিসহ প্রায় দেড়শ’ পুলিশ সদস্য পাকবাহিনীর হাতে আটক হই। আটক হওয়ার পর, আমাদের উপর নির্মম নির্যাতন করা হয়। অনেককেই বেয়োনেট দিয়ে খোঁচায় পাক সেনারা। এরপর ২৮ মার্চ আমরা ছাড়া পাই। সে সময়ে পাকিস্তান পুলিশের একজন আইজিপি এসে রাজারবাগের দায়িত্ব নেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরই আমরা বেশ কয়েকজন ছাড়া পাই। এরপর আমি রামপুরায় আমার বাসায় যাই। সেখান থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মেঘালয় রাজ্যে। সেখানে আমি মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিই। পরবর্তীতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।
সম্পাদনা: আশিক রহমান