বাংলা চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা
ইমরুল শাহেদ : চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক বিপর্যয় দেখে অনেকে মনে করেন চলচ্চিত্র একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তাদের যুক্তি হলো, দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা কমতে কমতে ১৩ শ’ থেকে নেমে এসেছে চার শ’-তে। কিন্তু অর্থনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে নির্মাণ ব্যয় বাড়ছে প্রতিনিয়ত। আগে একটি ছবির সেন্সর প্রিন্ট পর্যন্ত ব্যয় হতো ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা সেটা এখন গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকায়। টিকিটেরও দাম বেড়েছে। তারপরও ছবি মুক্তি দিয়ে কত টাকাই-বা ফেরত আসে প্রযোজক-পরিবেশকের ঘরে। নানা ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রাখা হয়েছে প্রযোজকদের জন্য। প্রদর্শকরাও নানা ধরনের ঝক্কি মোকাবিলা করছেন। চলচ্চিত্র ব্যবসায় যে তৃতীয় পক্ষ রয়েছে লাভবান হচ্ছে কেবল তারাই। তাদের কোনো লগ্নী নেই, আছে কেবল প্রাপ্তি। প্রযোজক এবং প্রদর্শক – দু’পক্ষ থেকে কমিশন নিয়ে তাদের তৎপরতা সজীব রয়েছে। তাই মাঝে মাঝেই তৃতীয় পক্ষ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তাদেরকে পরিহার করলে কেমন হয়? এ ধরনের প্রস্তাব আছে, কিন্তু উদ্যোগ নেই রুখে দাঁড়ানোর। এমনি উদ্যোগহীনতা বিরাজ করছে চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায়। তারপরও কী থেকে আছে ছবির উৎপাদন?
অভ্যাগতরা চলচ্চিত্র নির্মাণের সূতিকাগার এফডিসিতে উপস্থিত হয়ে যখন দেখেন কোনো ফ্লোরেই শুটিং নেই তখন তারা হতাশই হন। তারা মনে করেন ছবি নির্মাণ থেমে গেছে। এ শ্রেণীর লোকেরাই আবার সিনেমা হলে গিয়ে দেখেন কোনো ছবিই তেমন একটা দর্শকগ্রাহ্য হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনে হয়, ছবি চলছে না উৎপাদন থাকবে কোত্থেকে?
না, ব্যবসায়ের এই নাজুক পরিস্থিতিতেও ছবির উৎপাদনে কমতি নেই। গত শুক্রবার এফডিসির একটি ফ্লোরে রফিক সিকদার পরিচালিত হৃদয় জুড়ে ছবির শুটিং হচ্ছিল। এ ছবিতে কাজ করতে ভারত থেকে এসেছেন প্রিয়াংকা সরকার। সঙ্গে এসেছে তার সন্তানটিও। তার সঙ্গে কাজ করছিলেন নীরব। একই দিন উত্তরা বিভিন্ন স্থানে শুটিং হচ্ছিল কামরুল ইসলাম পরিচালিত পুলিশ বাবু ছবির। সে অঞ্চল অতিক্রম আরেকটু এগিয়ে গেলে পূবাইল লোকেশনে কাজ হচ্ছিল হাসিবুল ইসলাম মিজান পরিচালিত ফুলবাবু ছবির।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে চলচ্চিত্র এখন আর এফডিসি নির্ভর নয়। শুটিং, ডাবিং, সম্পাদনা বা অন্যান্য কারিগর কাজ এফডিসিতেই করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। প্রযুক্তির পরিবর্তনের কারণে এখন চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়ে পড়েছে বিকেন্দ্রিক। ডিজিটাল প্রযুক্তি চলচ্চিত্র নির্মাণকে সহজ ও সস্তা করে তুলেছে। চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য যে প্রযুক্তি প্রয়োজন তা এফডিসির কাছে পুরোপুরি নেই। থাকলেও রেট এতো উচ্চ যে সেগুলো ব্যবহারে কেউ আগ্রহী হন না। এভাবেই চলচ্চিত্র উপর থেকে এফডিসির একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হয়ে গেছে এবং চলচ্চিত্র চলে গেছে এফডিসির নাগালের বাইরে।
পক্ষান্তরে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকা মহানগরীর আনাচে কানাচে। মগবাজারের একজন প্যানেল মালিক জানালেন, গান রেকর্ডিং থেকে সব ধরনের কারিগরি সহায়তা দেওয়ার মতো ১২৫ থেকে ১৫০টি হাউজ বা প্যানেল সক্রিয় আছে। নির্মাতারা এসব প্যানেলের যে কোনোটি থেকেই সহায়তা নিতে পারেন। আগে এসব প্যানেল থেকে নাটক নির্মিত হতো। এখন চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সেগুলো ব্যবহার হচ্ছে। নাট্য নির্মাতারা হয়ে যাচ্ছেন চলচ্চিত্রকার। কিন্তু তারা যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তখন তারা ক্লোজ মিডিয়া ও ওয়াইড মিডিয়ার তফাতটাও ভুলে যান। তাদের বেশির ভাগই টেলিফিল্ম বানিয়েই বলতে শুরু করেন তারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। মুক্তির পর ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। চলচ্চিত্র ব্যবসায় যেসব কারণে ধস নেমেছে তার মধ্যে এটিও একটি কারণ। এসব নির্মাতাদের দাপটের মুখে চলচ্চিত্রের প্রকৃত নির্মাতারা পিছিয়ে পড়েছেন। চলচ্চিত্র যেমন এফডিসির নাগালের বাইরে চলে গেছেন তেমনি প্রকৃত নির্মাতাদেরও নাগালের বাইরে চলে গেছে। নির্মাণ প্যানেলগুলো যেমন ছড়িয়ে পড়েছে তেমনি ছবি নির্মাণের লোকেশনও ছড়িয়ে পড়েছে। এখন বেশির ভাগই ছবিই নির্মিত হচ্ছে ঢাকার বাইরে এবং দেশের বাইরে। ঢাকার বাইরে হলে বিশেষ
বিশেষ করে কক্সবাজার লোকেশন বেশ জমজমাট। আার দেশের বাইরে হলে থাইল্যান্ড, ব্যাংকক। লোকেশনে বৈচিত্র থাকলেও গল্প-কাহিনীতে খুব বেশি বৈচিত্র নেই এখনকার সিনেমার। বেশির ভাগ সময়ই গতানুগতিক প্রেমকাহিনী অথবা আর্টফিল্ম হলে খুব বড়জোর মুক্তিযুদ্ধ অথবা দরিদ্রতাকে জোর দেয়া হয়। কিন্তু, কী হলে একটি ছবি প্রকৃত অর্থেই ভালো হয় তা সত্যিকারার্থেই জানেন না এখনকার পরিচালকরা। এ নিয়ে সত্যজিত রায় তাঁর ‘বাংলা চলচ্চিত্রের আর্টের দিক’ বইয়ে মন্তব্য করেন, ‘…ভাল ছবি কাকে বলে? ভাল গল্প মানে ভাল ছবি। অনেককেই এমন কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু তাই যদি হবে তা’হলে বাংলাদেশের ছবির ইতিহাসে ভাল ছবির এত অভাব হল কেন? বাল্মীকি, বেদব্যাস থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের সেরা সাহিত্যিকদের কত ভাল গল্পইতো ছবি হয়ে দেখা দিয়েছে। কাহিনীর দৈন্য তো সেখানে ছিল না। তবে কিসের দৈন্য, কিসের অভাব তাঁদের শিল্পসাফল্য থেকে বঞ্চিত করল? আসলে কাহিনী মাত্রেরই দুটো দিক আছে-এক হলো তার বক্তব্য, আরেক হলো তার ভাষা। এই দু’য়ে মিলে গল্প। গল্পের আর্ট এই বলার ভঙ্গিতে। ভাল গল্প বলার দোষে নষ্ট হয় যায়। সামান্য কাহিনী বলার গুনে শিল্পমন্ডিত হয়ে উঠে। চলচিত্র শিল্পও তার ভাষায়, তার বিন্যাস- কৌশলে।…’