২৫ মার্চের ডায়েরি বিভিষীকার প্রথম শিকার ছিল রাজারবাগ
মো. মনিরুজ্জামান
২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে নারকীয় গণহত্যা শুরু করে তার প্রথম টার্গেট ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি এলাকা। পুলিশের অকুতোভয় সদস্যরা তাজা রক্ত দিয়ে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলে। কেমন ছিল ২৫ মার্চ রাজারবাগের ঘটনাপ্রবাহ তার কিয়দংশ নিচে তুলে ধরা হলোÑ
দুপুর ২টা : বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে নানারকম সংবাদ আসতে থাকে। পুলিশ কন্ট্রোলরুম থেকে সারা শহরে পেট্রোল পার্টি পাঠানো হয়। পেট্রোল পার্টি বেতার মারফত সংবাদ পাঠাতে থাকে যে, শহরের অবস্থা থমথমে ও আতঙ্কগ্রস্ত।
বিকাল ৪টা: মিরপুর, তেজগাঁও শ্রমিক অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে সংবাদ আসতে থাকে অবাঙালি শ্রমিকরা বিভিন্ন স্থানে আক্রমণাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সন্ধ্যা ৭টা: রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পুলিশি সূত্রসহ নানা রাজনৈতিক সূত্র থেকে সংবাদ আসতে থাকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ চালানো হতে পারে। এ সংবাদে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা বিক্ষিপ্তভাবে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ এবং তাদের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেন।
রাত ১০টা: তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে টহলরত একটি পুলিশ পেট্রোল পার্টি (চার্র্লি-৭) বেতার মারফত জানায় যে, সেনাবহিনীর একটি বড় কনভয় যুদ্ধসাজে শহরের দিকে এগুচ্ছে।
রাত ১০.৩০ : বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে পুলিশ পেট্রোল পার্টি সংবাদ পাঠায় যে, রমনা পার্কের (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সেনাবাহিনীর অন্তত ৭০-৮০টি সাঁজোয়া যান পূর্ণ পস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছে।
রাত ১১টা: হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে অবস্থানরত পেট্রোল পার্টির সদস্যগণ সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানের বহরকে ওই এলাকা অতিক্রম করতে দেখে। পুলিশ পেট্রোল কারটি ভিন্ন পথে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পৌঁছে এ সংবাদ দেয়। রাজারবাগে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা যে যার মতো প্রতিরোধযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
রাত ১১.২০ : সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানসমূহ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের চারদিকে অবস্থান নিতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনীর এই আক্রমণের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে সারা দেশের জেলা ও সাবডিভিশনসমূহে পুলিশ বেতার মারফত প্রেরণ করা হয়। সংবাদটি ছিল এমন- ইধংব ভড়ৎ ধষষ ংঃধঃরড়হ ড়ভ ঊধংঃ চধশরংঃধহ চড়ষরপব, শববঢ় ষরংঃবহরহম, ধিঃপয, বি ধৎব ধষৎবধফু ধঃঃধপশবফ নু ঃযব চধশ অৎসু. ঞৎু ঃড় ংধাব ুড়ঁৎংবষভ, ড়াবৎ
এসময় রাজারবাগ ওয়ারলেস বেজে উপস্থিত ছিলেন এএসআই ইয়াছিন আলী তরফদার, কং মুসলিম আলী শরীফ, কং মনির হোসেন, কং মতিউর রহমান মতিন, কং আব্দুল লতিফ, কং সোহরাব হোসেনসহ আরও অনেকে।
রাত ১১.৩৫: রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা অস্ত্রাগারের ঘণ্টা পিটিয়ে সবাইকে সতর্ক ও একত্রিত করে। অস্ত্রাগারে কর্তব্যরত সেন্ট্রির রাইফেল থেকে গুলি করে অস্ত্রাগারের তালা ভাঙে এবং তৎকালীন আরআই মফিজ উদ্দিনের নিকট থেকে জোরপূর্বক অস্ত্রাগারের চাবি নিয়ে নিজেদের মাঝে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিতরণ করে। প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পুলিশ সদস্যবৃন্দ পুলিশ লাইনসের চারদিকে, ব্যারাক ও বিভিন্ন দালানের ছাদে অবস্থান নেয়।
রাত ১১.৪০: পাকসেনাদের কনভয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের মেইন গেটে এসে পৌঁছে। বাঙালি পুলিশ সদস্যরাও রাজারবাগ ব্যারাকের ছাদে, বিভিন্ন বিল্ডিং-এ এবং পুলিশ লাইনসের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে পজিশন নেয়।
রাত ১১.৪৫: রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের দক্ষিণ-পূর্ব দিক (পুলিশ হাসপাতাল কোয়ার্টার সংলগ্ন) থেকে প্রথম গুলিবর্ষণ হয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্যারেড গ্রাউন্ডের উত্তর-পূর্ব দিক (শাহজাহানপুর রেল ক্রসিং) থেকে গুলির শব্দ শোনা যায়। ব্যারাকের ছাদে অবস্থানরত বাঙালি পুলিশ সদস্যরা পাকসেনাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। শুরু হয় দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ। ইতিহাসে সূচনা হয় একটি নতুন অধ্যায়ের।
রাত ১২.০০: বাঙালি পুলিশ সদস্যদের মরণপণ প্রতিরোধে থমকে যায় ট্যাংক ও কামান সজ্জিত পাকবাহিনী। একটু পরই মর্টার ও হেভি মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পিআরএফ এর ৪টি ব্যারাকে আগুন ধরে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাংক বহরসহ প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রবেশ করে। এ আক্রমণে তাদের সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় আটশ।
রাত ১২.৩০: পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা তাদের কৌশল পরিবর্তন করে। গেরিলা পদ্ধতিতে পাকবাহিনীর ওপরে হামলা চালায় এবং অনেককে হতাহত করে। অপর একটি গ্রুপ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ মালিবাগ, চামেলীবাগ প্রান্ত দিয়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের সেদিনকার সেই অস্ত্র আর গোলাবারুদ ব্যবহৃত হয়েছে সারাদেশে, সীমান্তবর্তী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে এবং সম্মুখযুদ্ধে।
রাত ২.৪৫: রাত ১১.৪৫ মিনিটে শুরু হওয়া যুদ্ধ থেমে থেমে চলতে থাকে রাত ৩.০৩ পর্যন্ত। বাঙালি পুলিশের কিছু সদস্য বুকে অসীম সাহস নিয়ে সমান তালে লড়ে চলে ট্যাংক, কামান আর মর্টারের বিরুদ্ধে।
রাত ৩.৩০: কামান আর মর্টারের আক্রমণ এক সময় থামে। বন্দি হয় প্রায় দেড়শ বাঙালি পুলিশ। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস করায়ত্ত করে দখলদার বাহিনী। তার আগেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের কিছু বীর বাঙালি পুলিশ অস্ত্র, গোলাবারুদসহ রাজারবাগ ত্যাগ করেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে।
গ্রন্থ : মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ
লেখক : এআইজি (কনফিডেন্সিয়াল), পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা।
সম্পাদনা: রফিক আহমেদ