বলতে পারে না, প্রভু ওকে নিয়ে যাও না কেন
ওসমান্ড রড্রিগ্স্
অনেক সময় দোকানের সেডের নিচে, ভেজা কাকের মতো দাঁড়িয়ে থেকে শেষমেশ বৃষ্টির মধ্যেই সুমনকে বাসায় রওয়ানা হতে হলো। বেচারা অফিস থেকে ফেরার পথে বাজার করে ফিরছিল। রাস্তায় হঠাৎ বৃষ্টি নামে এবং ছাতা সঙ্গে ছিল না তাই এই অবস্থা। গায়ে ঠা-া লেগে যাবে ভয়ে দাঁড়িয়ে না থেকে সে ভিজে ভিজেই বাসায় রওয়ানা হলো। স্ত্রী অঞ্জনা দেখে বলল, তাড়াতাড়ি কাপড় ছেড়ে স্নান করে নাও। এদিকে সুমনের ক্ষুধায় বমি বমি লাগছিল। অগত্যা কি করা, তাড়াতাড়ি সামান্য কাক স্নান সেরে শীতে কাঁপতে কাঁপতে নাস্তা খেতে বসল।
অঞ্জনা বাজার খুলে মাছ তরকারিগুলো দেখে বলল, ইলিশ মাছ পাওনি? সুমন এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, জলদি চা দাও। খানিক বাদে স্ত্রী চায়ের কাপ হাতে এসে বলল, সস্তায় মাছ পেলে দু-একদিনের মাছও তো কিনে রাখতে পার। প্রতিদিন কিসের বাজার? এভাবে ভিজে ভিজে সর্দি জ্বর লাগাও! সুমন চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, স্মৃতি কোথায়। অঞ্জনা বলল, ওর আজ অনেক জ্বর হয়েছিল। ঠান্ডা পানি দিয়ে মাথা ধুইয়ে দিয়েছিলাম। এখন বোধহয় জ্বর কম আছে। সুমন এবার জোর দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, স্মৃতি কোথায় ? অঞ্জনা বলল, বারান্দায় বসে আছে। সুমন দেরী না করে চলে গেল স্মৃতিকে দেখতে।
স্মৃতিতি ওদের একমাত্র মেয়ে সন্তান। ওর হাত ধরে কানে কানে ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করল, মা কেমন আছ? স্মৃতিতি শুধু মুচকি হেসে তার জবাব দেয়। স্মৃতিতি শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়ে প্রতিবন্ধী। কোনো মতে হাঁটতে পারে, তবে সে যা বলে, তা সুমন ও অঞ্জনা ছাড়া বাইরের লোক কেউ তা বুঝতে পারবে না। তাদের মেয়ে ‘স্মৃতিতি’ সুমন ও অঞ্জনার জীবনে এক ব্যথা, তাদের সংসারে স্মৃতিতিই এক বিরাট সমস্যা। স্মৃতিতি ওদের চাঁপা ক্রন্দন ও হতাশা।
আমাদের কারও কারও ঘরে এমনি খোঁড়া, পঙ্গু, বোবা, অন্ধ বা প্রতিবন্ধী রয়েছে। অনেকেই অনেকের খবর জানি না বা রাখি না। হাত পা ভাঙা, অন্ধ, বোবা বা ভীষণ অসুস্থ এমনি রাস্তা ঘাটে দেখি বটে। হাসপাতাল বা ক্লিনিকে গেলে দেখা যায় কত রকমের রোগী, কত অসহায় মানুষ। রোগের চিকিৎসা হচ্ছে, রোগী ভাল হচ্ছে, হসপিটালের বেডে দীর্ঘদিন আধমরা হয়ে শুয়ে আছে অথবা কেউ যন্ত্রণায় ছটফট করছে, আর কেউবা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। কিন্তু যারা অন্ধ, পঙ্গু বা প্রতিবন্ধী, তারা যেমনি হাসপাতালে থাকার যোগ্য নয়, তেমনি বাড়িতে থেকেও সুবিধায় নেই। না পারে এরা নিজেরা চলতে, না পারে আত্মীয়-স্বজন এদের সঠিক পরিচর্যা করতে। সংসারে এ ধরনের কেউ থাকলে, সংসারে থাকে এক বিরাট বাড়তি ঝামেলা। আর যদি সে রকম পরিচর্যার কেউ না থাকে তো হয় বেহাল অবস্থা। চাকর-বাকর দিয়ে সব কাজ হয় না এবং সব কাজ করানোও উচিত নয়। ওরা যেমনি আদর করবে না, তেমনি সঠিক যতœও নিতে পারবে না। যারা পঙ্গু তারা অসহায়। এরা অন্যের উপর নির্ভরশীল। এরা অন্যের আদরের অপেক্ষায় থাকে। আর যারা শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, তারা বৃদ্ধ হওয়া পর্যন্ত সেই অবোধ শিশুরই মতো থাকে, বুদ্ধি আর হয় না। এদের নিয়ে হয় হাজারো সমস্যা। এরা শতকরা একশত ভাগই অন্যের উপর নির্ভরশীল। এ ধরনের প্রতিবন্ধীদর সেবা সবাই করতেও জানে না, এমনকি করতেও চায় না। এ ধরনের সমস্যা আমাদের কারও কারও ঘরে আছে কিন্তু আমরা অনেকেই তা জানি না। কেউবা জানলেও উপলব্ধি করি না যে, সত্যি পরিবারটা কত অসুবিধায় আছে।
সুমন স্মৃতিতিকে ধরে আবারও আদর করল ও ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, মা খারাপ লাগছে? স্মৃতিতি আদর পেয়ে শুধু মলিন হাসল। সুমন বলল, মা বস, আমি দোকান থেকে আসিছ। স্মৃতিতি মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝার ভান করল। পেছনে দাঁড়ানো অঞ্জনা বলল, গায়ে জ্বর কেমন দেখলে? সুমন ভ্রু কুঁচকে বলল, জ্বর বোধহয় নেই, তবে ডাক্তার দেখাবো কিনা? অঞ্জনা বলল, আজকের দিনটা না হয় দেখি। তবু সুমন নাপা সিরাপ ও আঙ্গুর নিয়ে এলো। রাতে শোবার আগে জ্বর নেই বিধায় আর ঔষধগুলো খেতে দিল না। এখন ওদের নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোবার কথা। সুমন ঘড়িতে দেখলো রাত বারোটা বেজে ১৮ মিনিট। এবার চোখ বুজে ঘুমবার চেষ্টা করবে।
রাতে বিছানায় শুয়েও ওদের ঘুম আসছিল না, নানা কথায় হাই তুলে সময় পার করছিল সুমন ও অঞ্জনা। স্মৃতিতি অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। গায়ে পাতলা একটা চাদর দেওয়া ছিল। সুমন অঞ্জনাকে বলল, ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখ তো, জ্বর বাড়ল কিনা? অঞ্জনা হাত দিয়েই জোরে বলে ওঠে, ওগো, ও যে পুড়ে যাচ্ছে। ওরা দুজনই তারাতারি উঠে বসল। বাতি জ্বালিয়ে দেখা গেল স্মৃতিতি যেন কাঁদছে, তবে শব্দ করে নয়। সুমন তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে বালতি করে পানি নিয়ে এলো। মাথা ধোয়ানোর পর স্মৃতিতির জ্বর কমতে আরম্ভ করল। মাথা মোছাতে মোছাতে অঞ্জনা কেঁদে কেঁদে ঈশ্বরে কাছে দুঃখ করে বলছিল, ঈশ্বর তুমি কেন এত নিষ্ঠুর, কেন ওর একটু সহায় হও না, ওকে কেন অতো কষ্ট দিচ্ছ ইত্যাদি ইত্যদি। তারপর ওকে শোয়ায়ে দিয়ে অঞ্জনা মিষ্টি করে জিজ্ঞাসা করল, মা, ভাল লাগছে? স্মৃতিতির ভালই লাগছে, এমনি চেহারা করে মার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করল। অঞ্জনা স্মৃতিতিকে জড়িয়ে শুয়ে রইল, আর সুমন ওদের দিকে তাকিয়ে বিছানায় বসেই রইল। কত রাতই তো ওদের এইভাবে জেগে জেগে কাটাতে হয়, এ আর নতুন কিছু নয়। সুমন ও অঞ্জনা ভাবে, ওরা স্মৃতিতিকে নিয়ে ভবিষ্যতে কি করবে? ওরা মারা গেলে কেইবা স্মৃতিতিকে দেখবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তবু ওরা ঈশ্বরকে বলতে পারে না, ‘প্রভু, ওকে নিয়ে যাও না কেন?’ ওযে তাদের প্রথম সন্তান এবং ‘স্মৃতিতি’কে অত্যন্ত ভালবাসে। স্মৃতিতির কিছু হলে, ওরা যে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। ঈশ্বর ও মা মারীয়ার কাছে সাহায্য চায়, যেন তারা এই ‘ক্রুশ’ ঠিক মতো বইতে পারে।
হঠাৎ দোয়েল পাখির ডাক শোনা গেল। ভোর হয়ে এলো। সকালে অফিসে যেতে হবে। সুমন চিন্তা করল, আর শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা না করাই ভাল। অঞ্জনা স্মৃতিতিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। সুমন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ভোরের আভায় ওদের নির্মল মুখগুলোর দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে।