সাড়ে ৩শ বিচারকের পদ শূন্য, ব্যাহত হচ্ছে মামলা পরিচালনা
এস এম নূর মোহাম্মদ: নিম্ন আদালতের সাড়ে ৩শ বিচারকের পদ শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন যাবত। এসব পদ পূরণে সুপ্রিম কোর্ট থেকে চিঠি দেওয়া হলেও এসব পদ এখনো পূরণ হয়নি। আর বিচারক না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে মামলা পরিচালনা। বাড়ছে মামলা জটও।
একটি জেলার সর্বোচ্চ বিচারিক কর্মকর্তা জেলা ও দায়রা জজ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছয় জেলায় জেলা ও দায়রা জজের পদ শূন্য রয়েছে। এসব জেলায় জেলা ও দায়রা জজ না থাকায় বিচার প্রশাসন ও বিচারিক কাজ বিঘিœত হচ্ছে। মামলা নিষ্পত্তিতে কমে আসছে গতি। এর প্রভাবে ভোগান্তি বাড়ছে বিচারপ্রার্থীদের।
এছাড়া জেলা জজ পদ মর্যাদায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পদ ২০টি, বিশেষ জজের ৪টি, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সদস্যের পদ ৩টি, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের পদ ২টি এবং শ্রম আদালতের চেয়ারম্যানের ২টি পদ খালি রয়েছে। এর বাইরে জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার প্রেষণে ৭টি পদ খালি রয়েছে।
এছাড়া অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সমপর্যায়ের পদ খালি রয়েছে ৯টি। যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ সমপর্যায়ের ১৬টি পদ খালি রয়েছে। সিনিয়র সহকারী ও সহকারী জজ পর্যায়ের পদ খালি রয়েছে ১২৩টি। আর সবচেয়ে বেশি সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রটের পদ খালি পড়ে আছে ১৫৯টি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি জয়নুল আবেদীন এ প্রতিবেদককে বলেন, এমনিতেই আইনের শাসনের অভাব। সরকারের কাছে বিচার ব্যবস্থা জিম্মি হয়ে আছে, ঠিকভাবে চলতে দিচ্ছে না। তারা চাচ্ছে না মানুষ সহজভাবে বিচার পাক।
তিনি বলেন, বিচার না হলে তো মানুষ দিনের পর দিন কারাগারে আটক থাকে। বিচারক না থাকায় আইনের শাসন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অবশ্যই দক্ষ ও নিরপেক্ষ বিচারক দিয়ে দ্রুত এসব শূন্য পদ পূরণ করা উচিত। বিচার বিভাগ অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এ বিভাগকে কোনো অবস্থাতেই দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে হবে না। তাহলে দেশের মানুষ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হবে বলে মনে করেন তিনি।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) মো. সাব্বির ফয়েজ বলেন, গত বছর থেকেই এসব পদ শূন্য। যার কারণে গত বছর মামলা নিষ্পত্তি তুলনামূলক কম হয়েছে। খালি থাকা পদের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট থেকে সরকারকে জানানো হয়েছে। এখন তারা পদক্ষেপ নিবে। তিনি বলেন, বর্তমানে ১শ সহকারী জজ নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তাদের মেডিকেল টেস্টের পর পুলিশ ভেরিফিকেশন হবে। তারপরই তাদের নিয়োগ চূড়ান্ত হবে।
এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, এটা একটা সংকট। আমি মনে করি বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি নিরসনে অবিলম্বে শূন্য পদ পূরণ করা উচিত। সরকারকে এ বিষয়ে আরও বেশি আন্তরিক হতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোর, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, খাগড়াছড়ি ও সিলেট জেলার জেলা ও দায়রা জজের পদ শূন্য রয়েছে। জেলা জজের পদ শূন্য (নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল) রয়েছে নাটোর, নীলফামারী, বাগেরহাট, জামালপুর, চট্টগ্রাম-২ ও ৩, সুনামগঞ্জ, রংপুর, কুড়িগ্রাম, শেরপুর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, খুলনা, রাজশাহী-২, পাবনা, কক্সবাজার, পটুয়াখালী, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া ও নেত্রকোণায়। বিশেষ জজের পদ শূন্য রয়েছে নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও জামালপুরে। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের পদ শূন্য রয়েছে বরিশাল, ঢাকা-১ ও খুলনায়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বরিশাল ও চট্টগ্রামের পদও শূন্য রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামের একটি এবং রাজশাহীর শ্রম আদালতের চেয়ারম্যানের পদও শূন্য রয়েছে।
এর বাইরে ঢাকার ট্যাক্সেস আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সদস্য, ঢাকার কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সদস্য, ৬৪টি জেলা সদরে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন নির্মাণ প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়ক, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পরিচালক, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের আইন কর্মকর্তার পদও বর্তমানে শূন্য রয়েছে বলে জানা গেছে।
অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ পদ মর্যাদার মধ্যে রাজবাড়ী, বগুড়া, চট্টগ্রাম, নাটোর, সিলেট, চুয়াডাঙ্গা, নীলফামারী, পঞ্চগড় ও ফরিদপুরের বিচারকের পদ শূন্য রয়েছে। আর যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজদের মধ্যে ঢাকা, খুলনা, মাগুরা, রাজশাহী, নওগাঁ, রংপুর, লালমনিরহাট, বরিশাল, ঝালকাঠি ও চট্টগ্রামের বিচারকের পদ শূন্য রয়েছে। সেইসঙ্গে খালি রয়েছে বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের উপ-পরিচালক, আইন কমিশনের সিনিয়র গবেষণা কর্মকর্তা, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সচিব এবং কুড়িগ্রাম ও পটুয়াখালীর অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের পদও।
সিএমএম ও সিজেএম আদালতের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের ২৫টি, চট্টগ্রাম বিভাগের ২৮টি, সিলেট বিভাগের ৭টি, খুলনা বিভাগের ২৬টি, বরিশাল বিভাগের ১৪টি, রাজশাহী বিভাগের ৩০টি এবং রংপুর বিভাগের ২৯টি পদ খালি রয়েছে।
এছাড়া সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজ পদ মর্যাদার ঢাকা বিভাগের ৩২টি, চট্টগ্রাম বিভাগের ৯টি, সিলেট বিভাগের ৯টি, খুলনা বিভাগের ১৯টি, বরিশাল বিভাগের ১১টি, রাজশাহী বিভাগের ১৮টি এবং রংপুর বিভাগের ২৫টি খালি রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছর সারা দেশে ১৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫৬৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয় ৯ হাজার ৬৩৪টি আর হাইকোর্ট বিভাগে নিষ্পত্তি হয় ৩৯ হাজার ৮৭৮টি মামলা। এছাড়া জেলা ও দায়রা জজ আদালতগুলোতে নিষ্পত্তি হয় ৫ লাখ ৩ হাজার ২৪৬টি মামলা এবং ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে নিষ্পত্তি হয় ৭ লাখ ৮০ হাজার ৮০৫টি মামলা।
গতবছর একই সময়ে সারাদেশে বিচারাধীন ছিল ৩১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৭৮টি মামলা। যার মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ১৩ হাজার ৬৭২ টি এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৪ লাখ ২৪ হাজার ৯৯৪টি মামলা। এছাড়া জেলা ও দায়রা জজ আদালতগুলোতে ১৮ লাখ ৫২ হাজার ৬৭৬ এবং ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে বিচারাধীন ছিল ৮ লাখ ৬৫ হাজার ৫৩৬টি মামলা।
এর আগে ১৫ সালে সারাদেশে নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৬। একইসময়ে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩১ লাখ ৯ হাজার ১৭৩টি। তার আগে ২০১১ সালে সারাদেশে নিষ্পত্তি হয় ৯ লাখ ৪৮ হাজার ৯৮৯টি মামলা। ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৩২ হাজার ১৮৯-এ। ২০১৩ সালে তা হয় ১১ লাখ ১৯ হাজার ২৯৪ এবং ২০১৪ সালে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৪ হাজার ৫৪৪-এ।
১৫ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান আপিল বিভাগের বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিচার বিভাগে নানা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেন তিনি। চেষ্টা করছেন বিচার বিভাগ পুরোপুরি ডিজিটালাইজড করার জন্য। আর তার নেওয়া এসব পদক্ষেপের কারণেই মামলা জট কমতে শুরু করে। আর ১৫ সালে রেকর্ড পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তি হয়। তবে বিচারক সংকটসহ নানা কারণে গত বছর মামলা নিষ্পত্তি কমে যায়। অবশ্য প্রধান বিচারপতিও সাম্প্রতিক সময়ে বিচার বিভাগে সরকারের নানা অহসযোগিতার কথা তুলে ধরছেন। সম্পাদনা: উম্মুল ওয়ারা সুইটি