মোদির ‘এক মজবুত সঙ্গী ও চমৎকার বন্ধু’ এবং বাস্তবের ‘বন্ধু’
মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে
ইংরেজি প্রবাদে বলে ‘এ ফ্রেন্ড ইন নিড ইজ এ ফ্রেন্ড ইনডিড’, অর্থাৎ ‘দুঃসময়ের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু’। এটি মনে করার কারণটি হচ্ছে : বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে শুভেচ্ছা জানিয়ে ‘এক মজবুত সঙ্গী ও চমৎকার বন্ধু’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সে কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে সেটিকে মিডিয়ায় একটি বিশেষ বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জনগণকে শুভেচ্ছা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তাতে তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের এক মজবুত সঙ্গী, চমৎকার বন্ধু। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহাসিক লড়াইয়ে জয় পান। তার ভাষায় ‘শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন মহামানব এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তার অবদান অপরিহার্য ছিল’। এছাড়া বাংলাদেশের যে কোনো প্রয়োজনে পাশে থাকার কথা জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত সব সময় বাংলাদেশের জনগণের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সে কথা যথার্থই বলেছেন। কেননা আমরা কৃতজ্ঞতাভরে আমাদের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানকে স্মরণ করি এবং সেসময় ভারতের জনগণ আমাদের এক কোটি শরণার্থীর জন্য যে আত্মত্যাগ ও সহমর্মিতা দেখিয়েছেন, তা বিস্মৃত হবার নয়।
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার গত ৪৬ বছরে এই শিল্পোন্নত ও পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশি ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের টানাপড়েনটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণে কালক্রমে একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিপাদ্য হয়েছে। আধিপত্যবাদ, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, আন্ত:দেশীয় বাণিজ্য, উন্নয়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ পরিম-লের বাইরে আপাতদৃষ্টিতে নদীমাতৃক বাংলাদেশের কাছে নদীর পানি বন্টন, উজানে বাঁধ নির্মাণ ও সীমান্তে নিরীহ মানুষ হত্যা যেমন অতি বিবেচিত দিক, তেমনি পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে চলমান বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য বাংলাদেশ অভয়ারণ্য হওয়া স্বাভাবিকভাবেই ভারতের জন্য এক দুর্ভাবনার কারণ। সেই দুর্ভাবনা বাংলাদেশেরও রয়েছে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে তথাকথিত ‘শান্তি বাহিনী’র উপদ্রবটি নানা কারণে স্ফূরিত হয়। এছাড়া সীমান্তে চোরাচালান, অপরাধীর পারাপার ও আশ্রয় প্রতিরোধ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এসব বিবেচনায় ‘বন্ধুত্বের পরিসরে’ ভৌগোলিক পরিব্যাপ্তি ও জনসংখ্যার অনুপাতে বৃহৎ ভারতের কাছে ক্ষুদ্র বাংলাদেশের মানবিক প্রত্যাশা কতখানি যুক্তিযুক্ত?
যদি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘এক মজবুত সঙ্গী ও চমৎকার বন্ধু’র সঙ্গে শুধুই বাস্তবের ‘বন্ধু’ বিষয়টি আক্ষরিক অর্থে বিশ্লেষণ করি, তবে এই দুই প্রতিবেশি দেশের প্রত্যাশা আরও স্বচ্ছ ও খোলাসা হয়, যা সূচনার ইংরেজি প্রবাদবাক্যেই অন্তর্নিহিত। সেক্ষেত্রে ‘বন্ধু চাওয়া’র চেয়ে প্রকৃত ‘বন্ধু হওয়া’টাই শ্রেয়। অবশ্য প্রযুক্তিনির্ভর আজকের পৃথিবীতে বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটাই পাল্টে গেছে। এখন সামাজিকমাধ্যমে ‘অঢেল বন্ধু’র ভাবনা আমাদের আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। সেটির ভালো দিকটি হচ্ছে আমরা যাদের কখনো দেখিনি, তাদেরও সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্নার সহভাগী হই। তথাপি ‘সংযোগের’ এই বেশুমার ‘বন্ধুরা’ কখনো পূর্ণমাত্রায় ‘আত্মিক’ হয় না। কেননা এই সামাজিকমাধ্যম আমাদের পরস্পরকে বার্তা পাঠাতে সাহায্য করে, অথচ ‘মুখোমুখি’ বা ‘পারস্পরিক’ সংবেদনশীলতাকে অর্থপূর্ণ করে না। এক্ষেত্রে ইংরেজিতে বন্ধুত্বের আরও দুটি প্রবাদ হচ্ছেÑ ‘চুস ফ্রেন্ডস হু শেয়ার ইউর ভ্যালুজ সো ইউ ক্যান স্ট্রেন্থেন অ্যান্ড এনকারেজ ইচ আদার ইন লিভিং হাই স্টান্ডার্ডস’। অর্থাৎ বন্ধু বেছে নিন যে আপনার মূল্যবোধের সহভাগী হবে, যাতে আপনি সুউচ্চ বসবাসের ক্ষেত্রে শক্তি ও অনুপ্রেরণা পাবেন। ‘এজ ইউ সিক টু বি এ ফ্রেন্ড টু আদার্স, ডু নট কম্প্রোমাইজ ইউর স্টান্ডার্ডস’। অর্থাৎ আপনি যখন কারো বন্ধু হবেন, তখন নিজের মর্যাদাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়।
আর তাই ভারত-বাংলাদেশের পারস্পরিক ‘বন্ধু’ সম্পর্কটি কী পর্যায়ে কীভাবে মূল্যায়িত, প্রত্যাশিত ও বিবেচিত হবে, সেটা সহজেই অনুমেয়। ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে আপনার মূল্যবান মন্তব্যে আমরা যথার্থই ‘দ্বিপক্ষীয় বন্ধুত্বের’ দিশাটি রূপায়নে মনোযোগী হব।
ই-মেইল: নঁশযধৎর.ঃড়ৎড়হঃড়@মসধরষ.পড়স