সিলেটে অভিযান শেষ, তালাশ চলছে
আজাদ হোসেন সুমন ও আশরাফ চৌধুরী রাজু: সিলেট দক্ষিণ সুরমার আতিয়া মহলে ৫ দিনব্যাপী শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান শেষ করেছে সেনাবাহিনী। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে সেনাবাহিনী জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহলের’ সার্বিক দায়িত্ব পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। এর মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর পাঁচ দিনব্যাপী জঙ্গিবিরোধী ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ শেষ হলো। বিষয়টি নিশ্চিত করে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এসএম রোকন উদ্দিন বলেন, বিকালে সেনাবাহিনী পুলিশকে আতিয়া মহলের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। এরপর পুলিশ ও দমকল বাহিনীর সদস্যরা ভবনটিতে ঢুকে। হস্তান্তরের আগে সেনা সদস্যরা ভবনের বিভিন্নস্থানে থাকা বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করে। ভবনের ভেতরে এখনো কিছু রয়ে গেছে কিনা এখন থেকে পুলিশ তা খতিয়ে দেখবে।
শ্বাসরুদ্ধকর ১১০ ঘণ্টা: সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে আটক জঙ্গিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি দল প্রায় এক সপ্তাহ আগে সিলেট আসে। নব্য জেএমবির কোনো শীর্ষ নেতা দলবলসহ সিলেটে অবস্থান করছে এটি নিশ্চিত হয়ে তারা প্রযুক্তির সহায়তায় সিলেটের দক্ষিণ প্রান্তে শিববাড়ি পাঠানপাড়া এলাকায় তাদের আস্তানার সন্ধান পায়। এই মহলের সামনে ১টি চারতলা ভবন এবং পিছনে ৫তলা ভবনের দুটি ইউনিটে বসবাস করে প্রায় ৪০টি পরিবার। তাদের মধ্যে রয়েছেন পুলিশ, ব্যবসায়ী, শিক্ষিকা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিবার। পিছনের ৫তলা ভবনের নিচ তলার বাম দিকের একটি ফ্লাটে জঙ্গিরা বসবাস করছে নিশ্চিত হয়ে ভোর রাতে পুলিশ ফ্ল্যাটটিতে বাইরে থেকে তালা দেয়। শুরুতেই দুটি বিল্ডিংয়ের কিছু পরিবারকে পুলিশ সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়। একপর্যায়ে হ্যান্ড মাইকে বাসার বাসিন্দাদেরকে বাসা থেকে বের হতে বলে পুলিশ। ঘিরে ফেলা হয়েছে তা আঁচ করতে পেরে জঙ্গিরা বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় সকালে। ফলে বাসার বিভিন্ন তলায় আটকা পড়ে যায় প্রায় ২৭টি পরিবারের ৭৮ জন সদস্য। আটকে পড়াদের মধ্যে ছিলেন গর্ভবতী নারী শিশু বৃদ্ধা। বেলা ১১টার দিকে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় র্যাব। পুলিশ সকাল থেকে হ্যান্ডমাইকে বাসার বিভিন্ন দিক থেকে জঙ্গিদেরকে আত্মসমর্পণের আহবান জানাতে থাকে। দুপুরের দিকে বাসার পূর্ব-দক্ষিণ দিকের জানালা ফাঁক করে নারী কণ্ঠের জবাব আসে, দেরি করছ কেন? আমাদের সময় কম। তাড়াতাড়ি সোয়াট পাঠাও।
এভাবে কেটে যায় প্রায় আরও ৪ ঘণ্টা। রাত পৌনে ৮টার দিকে ঘটনাস্থলে আসে সেনাবাহিনীর একটি দল। পরদিন সকাল পৌনে ৯টার দিকে শুরু হয় অভিযান। কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই প্রায় সকল আটকেপড়া বাসিন্দাদের বের করে নিতে সক্ষম হয় সেনাবাহিনী। এরপর শুরু হয় জঙ্গিদের ঘিরে অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি। দুপুর ২টায় একটি এপিসি নিয়ে ভবনটির উত্তর দিকে প্রবেশ করে কমান্ডোরা। এর কিছু সময় পর হতেই শুরু হয়ে যায় প্রচ- গুলি। বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। তাদের বাসার কাছে পৌঁছতেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। ছিটকে পড়েন ৪ কমান্ডো সদস্য। তবে তাদের কেউই আহত হয়নি। এরপরই অভিযানে গতি আনে কমান্ডোরা। রকেট লাঞ্চার ও মর্টার দিয়ে বাসার দেওয়ালে গর্ত করে গ্রেনেড চার্জ করে কমান্ডোরা। ভিতরে নিক্ষেপ করা হয় শত শত টিয়ার শেল। একপর্যায়ে জঙ্গিরা পুরো ৫তলা ভবনেই বিচরণ করতে থাকে। গ্রেনেড হামলা ও ফায়ার ব্যাক করে জঙ্গিরা সমান তালে লড়ে যাচ্ছিল। বিকাল ৫টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ থেমে থেমে শুনা যায়। সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে জহির তাহির স্কুলের পাশের ভবনে প্রেস-ব্রিফিং করে সেনাবাহিনী। এ সময় রাস্তায় উৎসুক জনতার মাঝখানে বিস্ফোরিত হয় একটি বোমা। তাতে ২ জন নিহত ও আহত হন প্রায় ২৫ জন। তাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ-র্যাব এই বিস্ফোরণস্থলটিতে তল্লাশি করতে আসে। এসময় ফেলে রাখা আরেকটি বোমা বিস্ফোরিত হলে মারা যায় পুলিশের দুই পরিদর্শক। আহত হন র্যাবের গোয়েন্দা প্রধানসহ র্যাব পুলিশের বহু সদস্য। পৃথক দুটি বিস্ফোরণে মোট নিহত হন ৬ জন । তাদের মধ্যে ২ জন পুলিশ কর্মকর্তা, ২ জন ছাত্রলীগ নেতা, ২ জন ডেকোরেটার্স ব্যবসায়ী। এছাড়াও আহত হন অন্তত ৫০ জন। এরপর গত রোববার সকাল হতেই শুরু হয় আবারও প্রচ- গুলি ও বিস্ফোরণ। দিনভর গুলি ও বিস্ফোরণের পর বিকাল সাড়ে ৫টায় পাঠানপাড়া জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে দ্বিতীয় দিনের প্রেস-কনফারেন্সে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান জানান অভিযানের দ্বিতীয় দিনে কমান্ডোদের গুলিতে ২ জন জঙ্গি নিহত হয় বলে জানান। আরও একাধিক জঙ্গি রয়েছে। জঙ্গিদের হাতে প্রচুর বিস্ফোরক রয়েছে। তারা ‘ওয়েল ট্রেইন্ড’। রোববার রাতেও থেমে থেমে গুলির শব্দ শুনা যায়। গত সোমবার ভোর থেকে বিকাল পর্যন্ত গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। এরপর থেকে আতিয়া মহল থেকে আর কোনো শব্দ শুনা যায়নি। রাত সাড়ে ৭টার দিকে অভিযান টোয়াইলাইটের ৬০ ঘণ্টা পর পাঠানপাড়া জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে তৃতীয় দিনের প্রেস-কনফারেন্সে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন, মোট ৪ জঙ্গির সকলেই নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩ জন পুরুষ ১ জন মহিলা। তবে ২ জঙ্গির লাশ পুলিশে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দুজন জঙ্গির লাশ এক্সপ্লোসিভ জড়ানো থাকায় ভিতরে পড়ে আছে। ভিতরে প্রচুর বিস্ফোরক মজুদ করেছিল। এগুলো সরানোর কাজে অভিযান শেষ হতে সময় লাগবে। সবগুলোতেই তারা সফল হয়েছে। যদিও অভিযানটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ভেতরের জঙ্গিরা ছিল উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং তাদের হাতে ছিল প্রচুর বিস্ফোরক ও ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস। তাদের সকলের শরীরেই ছিল সুইসাইডাল ভেস্ট। যা দিয়ে জঙ্গিদের ১ জন দ্বিতীয় দিনের অভিযানে কমান্ডোদের গুলিতে বিদ্ধ হলে এর বিস্ফোরণ ঘটায়। অপারেশন টোয়াইলাইট এর কমান্ডোরা মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টার অপারেশনে উদ্ধার করে ৭৮ জন বাসিন্দাকে। ৬০ ঘণ্টার অপারেশনে ৪ জঙ্গির সকলেই নিহত হয়। সব মিলিয়ে ১১০ ঘণ্টার মিশন সফলতার সঙ্গে শেষ করে সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডো ইউনিট। যাদের সহায়তায় ছিল পুলিশ, র্যাব ও ফায়ার ব্রিগেডের অকুতোভয় সৈনিকরা।
দুই জঙ্গির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন: নিহত চার জঙ্গির মধ্যে এক নারীসহ দুজনের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা পৌনে তিনটার দিকে তাদের দুজনের মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোহেল বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, গত সোমবার রাতে যে দুজন জঙ্গির লাশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল গতকাল মঙ্গলবার তাদের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। এর আগে ওই দুজনের ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়। তাদের পরিচয় নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত মর্গে লাশ থাকবে। এর আগে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডাক্তার সামছুল আলমের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের চিকিৎসক দল ময়নাতদন্ত শুরু করেন। তবে ময়নাতদন্তের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি চিকিৎসকরা। নিহত এ দুই জঙ্গির মধ্যে একজন মর্জিনা বলে ধারণা করছে পুলিশ। অপরজন কাওছার বা অন্য কেউ হতে পারে। তবে নিশ্চিত হতে ডিএনএ টেস্ট করা হবে।
পুরুষ জঙ্গি আত্মঘাতী, মহিলা পুড়ে মারা যায়: সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহত দুজনের মধ্যে পুরুষ জঙ্গিটি আত্মঘাতী বিস্ফোরণে এবং নারী জঙ্গি আগুনে পুড়ে মারা গেছে। গতকাল মঙ্গলবার পুরুষ লাশটির সুরতহাল করেন মোগলাবাজার থানার এসআই মো. সোহেল রানা এবং নারীর লাশের সুরতহাল করেন একই থানার এসআই সুজন দত্ত। সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহত ওই পুরুষের দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। তার গোলাকার মুখম-ল ছিল আগুনে পোড়া। মাথায় সামান্য চুল ও মুখে কিছু দাড়ি ছিল। তার পরনে ছিল কালো জামা ও দুই পায়ে ছিল কালো জুতা। লাশের বুক থেকে তলপেট পর্যন্ত পুরোটাই ছিল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। বাঁ পায়ের মাংস গোড়ালির টাকনু পর্যন্ত কাটা ছিল। উক্ত জঙ্গি সন্ত্রাসী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার এড়ানোর জন্য নিজে নিজে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মারা গেছে বলে অনুমান করা যাচ্ছে। অন্যদিকে নিহত নারী সম্পর্কে সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই নারীর দৈর্ঘ্য আনুমানিক চার ফুট। তার মুখম-ল ছিল পোড়া, মাথায় সামান্য চুল দেখা গেছে। দুই হাত ও দুই পায়ের গিড়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ দেহ পোড়া ছিল। একটি পায়ে সামান্য মাংস আছে এবং পায়ের তালুর নিচে আনুমানিক দুই ইঞ্চি কাটা। বুক ও পা দেখে বোঝা গেছে লাশটি একজন নারীর। প্রতিবেদনে বলা হয়, লাশটি একজন জঙ্গি সন্ত্রাসীর স্ত্রীর এবং গোপনীয়ভাবে জানা যায়, ওই নারী নিজেও একজন জঙ্গি সন্ত্রাসী দলের সদস্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার এড়ানোর জন্য নিজের গায়ে নিজে আগুন লাগিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে বলে অনুমান হয়। এদিকে, মঙ্গলবার অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে দুই লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শামসুল ইসলামের নেতৃত্বে চার সদস্যের চিকিৎসক দল ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। লাশ দুটি হিমাগারে রাখা হবে। পরিচয় নিশ্চিত হলে সেগুলো হস্তান্তর করা হবে। এই দুজন কাওসার আহমদ ও মর্জিনা বেগম হতে পারে বলে ধারণা পুলিশের। তবে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হতে আঙ্গুলের ছাপ ও ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানান কোতোয়ালি থানার ওসি সুহেল আহমদ। সম্পাদনা: রফিক আহমেদ