বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় জামিয়া কারাওইনের গল্প
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
নবম শতাব্দের প্রথম দিকের কথা। ইসলামের সোনালি যুগ তখন। মরক্কোর ফেজ নগরী ছিলো অনেকটা অজোপাড়া গাঁ। তখনকার শাসক দু’হাত তুললেন ঐশী দরবারে। কেঁদে কেঁদে ফরিয়াদ করলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি এ নগরীকে আইন ও বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে কবুল করুন।’ একদিন পূরণ হলো সেই স্বপ্ন। নগরীর এক ধনাঢ্য বিধবা এগিয়ে এলেন সেই লক্ষ্যে। কারাওইন মসজিদ চালু করলেন প্রথমে। এরপর ৮৫৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় মসজিদের অংশ হিসেবে। সেই মহীয়সী নারীর নাম ফাতিমা আল ফিহরি। তার বাবা ছিলেন শহরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আল ফিহরি।
‘আল ফিহরি’ পরিবার তিউনিসিয়ার কারাওইন থেকে ফেজে আসেন নবম শতাব্দের প্রথম দিকে। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম রাখা হয় ‘কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়’। তাদের সঙ্গে বেশকিছু লেখকও আসেন ফেজে। নগরীর পশ্চিমের অংশে বসবাস আরম্ভ করেন তারা। ফাতিমা আল ফিহরি ও তার বোন মারইয়াম আল ফিহরি ছিলেন সুশিক্ষিতা। উত্তরাধিকার সূত্রে তারা বাবার কাছ থেকে প্রচুর অর্থসম্পদ পান। ফাতিমা তার অংশের সব অর্থ ব্যয় করেন এই লেখকশ্রেণির জন্য মসজিদ তৈরির পেছনে। নিছক ইবাদতের স্থান না হয়ে মসজিদটি একসময় গড়ে ওঠে ধর্মীয় নির্দেশনা ও রাজনৈতিক আলোচনার স্থল হিসেবে। এটি নির্মাণ করতে সময় লেগে যায় ২৭৮ বছর। ইতালির বোলোনায় যখন প্রথম ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, তারও আগে কারাওইন হয়ে ওঠে দুনিয়াখ্যাত একটি অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়। শুরুতে এটি ছিলো ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র। পরে সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে জাগতিক বিষয় চালু করা হয়। অচিরেই এর শিক্ষার্থী সংখ্যা দাঁড়ায় আট হাজারে। চিকিৎসাবিদ্যা থেকে শুরু করে ইতিহাস-ভূগোলসহ নানা বিষয়ে তারা উচ্চশিক্ষা লাভ করতে থাকেন। ফেজকে তখন বলা হতো ‘বাগদাদ অব দ্য ওয়েস্ট’ বা ‘পাশ্চাত্যের বাগদাদ’।
ইউরোপের মহাজাগরণের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের সোনালি যুগের অবসান ঘটে। মধ্য-অষ্টাদশ শতাব্দ অবধি এসে দেখা গেলো, কারাওইন ছেড়ে গেছেন বহু জ্ঞানী-গুণী, বিজ্ঞানী। যাদের মধ্যে ইবনে রুশায়েদ আসসাবতি, মুহাম্মদ ইবনে আলহাজ আলআবদারি আলফাসি, তাত্ত্বিক মালিকি এবং পরিব্রাজক ও লেখক লিও আফ্রিকানাস উল্লেখযোগ্য। ১৯১২-৫৬ তে মরক্কো ছিলো ফ্রান্সের প্রটেক্টরেট। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়টি ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইউরোপের ষড়যন্ত্রের বলি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা ও ডিগ্রি দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৫৬ সালে মরক্কো স্বাধীন হয়। জাতিকে বিংশ শতাব্দের উপযোগী করে গড়ে তোলার দৃঢ়তা নিয়ে বাদশাহ মুহাম্মদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার চালু করেন কোরআন ও ফিকহ (ইসলামি আইনশাস্ত্র), ব্যাকরণ, অলংকারশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, ইতিহাস, ভূগোল ও সংগীতবিদ্যাসহ বিদেশি ভাষাবিষয়ক পাঠক্রম। একই সঙ্গে ১৯৫৭ সালে চালু করেন প্রতিষ্ঠানটির নারী শাখা। কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় এখন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম এক ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষাকেন্দ্র। এই বিশ্ববিদ্যালয় মধ্যযুগের মুসলমান ও ইউরোপীয়দের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাবিষয়ক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রাখে।
অনেক অমুসলিমও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির অন্যতম অমুসলিম অ্যালামনি ছিলেন ইহুদি দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ মুসা বিন মাইমুন বা মাইমোনাইডস। আর যেসব খ্রিস্টান প-িত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং স্কলার ছিলেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন বেলজিয়ামের নিকোলাস ক্লোনয়ার্টস ও ওলন্দাজ গোলিয়াস। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি উপহার দিয়েছে বিশ্বখ্যাত বহু মনীষী। ইবনে মাইমুন, আল-ইদ্রিসি, ইবনে আরাবি, ইবনে খালদুন, ইবনে খতিব, আল-বিতরুজি (অ্যালপে ট্রেজিয়াম), ইবনে হিরজিহিম ও আল ওয়্যাজ্জেন একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা শিক্ষক ছিলেন। গিনেস বুকের রেকর্ড অনুসারে প্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা বা ইউনেস্কোর রিপোর্টও একই। প্রথম দিকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মালেকি মাজহাব অনুসারে ইসলাম ধর্ম চর্চা করা হতো। ধীরে ধীরে একে রূপ দেওয়া হয় একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিষ্ঠানটির বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একটি হলো এর বিশ্বখ্যাত লাইব্রেরি। যাতে রয়েছে বিপুলসংখ্যক দুর্লভ পা-লিপি। হরিণের চামড়ার ওপর ইমাম মালেক (রহ.)-এর লেখা মোয়াত্তার পা-ুলিপি, ১৬০২ সালে সুলতান আহমদ আল মনসুরের দেওয়া কোরআনের কপি, সিরাতে ইবনে ইসহাক, ইবনে খালদুনের বই ‘আল ইবার’-এর মূল কপি এর মাঝে উল্লেখযোগ্য।
১৩৪৯ সালে সুলতান আবু ইনান ফ্যাবিস লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠা করেন। দুনিয়াখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান পরিচালক হলেন ড. আমাল জালাল। লেখক : শিক্ষার্থী, উচ্চতর হাদিস বিভাগ, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত।