আমলারা কি-না পারেন?
ইকতেদার আহমেদ
সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের আমলা বলা হয়, যদিও অষ্টম বেতন স্কেলে কর্মকর্তা শব্দটির বিলোপ সাধন করে সরকারি চাকরিজীবী সকলকে কর্মচারী নামে অভিহিত করা হয়েছে। অষ্টম বেতন স্কেল প্রবর্তন পূর্ববর্তী সরকারি চাকরিজীবীদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি নামক চারটি শ্রেণি ছিল। এ চারটি শ্রেণির প্রথমোক্ত দুটি শ্রেণির চাকরিজীবীরা কর্মকর্তা নামে এবং শেষোক্ত দুটি শ্রেণির চাকরিজীবীরা কর্মচারী নামে অভিহিত হতেন। অষ্টম বেতন স্কেলে শ্রেণি প্রথার অবসান ঘটিয়ে বলা হয় সরকারি কর্মচারীদের মর্যাদা গ্রেড ভিত্তিক হবে। বেতন স্কেলটিতে গ্রেডের সংখ্যা ২০টি উল্লেখ করা হলেও গ্রেড বহির্ভূত উপরস্থ ২টি বেতন স্কেলের বিধান রাখা হয়েছে। এ দুটি বেতন স্কেল হলোÑ ৮৬ হাজার টাকা মূল বেতনভুক্ত সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব ও তিন (সেনা, নৌ ও বিমান) বাহিনীর প্রধান এবং ৮২ হাজার টাকা বেতন স্কেলভুক্ত সিনিয়র সচিব। মূলত সচিব ও সিনিয়র সচিব একই পদ। কতিপয় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করে তাদেরকে সেনাবাহিনীর লে. জেনারেল পদধারীর সমকক্ষ করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে, অপরদিকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিবের বেতন স্কেল ৮৬ হাজার টাকা নির্ধারণ করত উভয়কে তিন বাহিনী প্রধানের সমকক্ষ করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। বেতন স্কেলে ঘোষিত গ্রেডের সংখ্যা বাস্তবিকই যদি ২০টি হয় তাহলে কি নীতিমালা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে গ্রেড বহির্ভূত ২টি উচ্চতর বেতন স্কেল রাখা হয়েছে এটি বোধগম্য নয়।
সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে সচিবের পদ শীর্ষ পদ। এ শীর্ষপদের মূল বেতন অতীতে সবসময় একই রূপ হতো; তবে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাতার ব্যবস্থা থাকত। বর্তমান বেতন স্কেল দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় এতে তিন ধরনের সচিবের জন্য তিন ধরনের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমনÑ ১নং গ্রেডভুক্ত সচিবের মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা, গ্রেড বহির্ভূত সিনিয়র সচিবের মূল বেতন ৮২ হাজার টাকা এবং গ্রেড বহির্ভূত মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিবের মূল বেতন ৮৬ হাজার টাকা।
বর্তমান বেতন স্কেল প্রবর্তন পূর্ববর্তী সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে যে সকল পদে পদোন্নতির সুযোগ সীমিত এবং যে সকল পদ পদোন্নতি যোগ্য নয় এ সকল পদের চাকরিজীবীরা টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের সুবিধা ভোগ করতেন। এ সুবিধার কারণে পদোন্নতি না হলেও টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের আওতায় তাদের বেতন বৃদ্ধি ঘটত যা তাদের ক্ষোভ ও হতাশা প্রশমনে সহায়ক ছিল। তাছাড়া এ সুবিধাদ্বয়ের কারণে তাদের বেতন উচ্চতর স্কেলে উন্নীত হতো।
সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে সচিবালয়ে কর্মরত উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব এ চারটি পদের কর্মরতরা সরকারের নীতিনির্ধারণীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ চারটি পদ সরকারের উচ্চতর চাকরি কাঠামোর পদ। এ পদগুলো কোনো ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত নয় যদিও এ পদগুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের অন্তর্ভুক্তদের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। বিগত এক বছরেরও অধিক সময় ধরে দেখা গেছে সচিবালয়ের এ চারটি পদের ক্ষেত্রে শূন্য পদ না থাকা সত্ত্বেও একাধিকবার পদোন্নতি কার্যকর করে পদোন্নতি প্রাপ্তদের স্বপদে অথবা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পদে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এতে সরকারের বিপুল রাজস্ব ক্ষতি হলেও এ ব্যাপারে এদের কাউকে কখনো উৎকণ্ঠিত হতে দেখা যায়নি।
সরকারের শীর্ষ পদধারীরা যখন শুধুমাত্র নিজেদের সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে তাদের কতিপয়ের অবস্থান গ্রেড বহির্ভূত সর্বোচ্চ গ্রেডের উচ্চে নির্ধারণ করেছেন এবং সচিবালয়ে কর্মরতদের ক্ষেত্রে পদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতির ব্যবস্থা করেছেন তখন দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অধ্যাপক পদধারীরা সিলেকশন গ্রেড বাতিলের কারণে অবমূল্যায়িত হয়ে সিনিয়র সচিবের নিম্নে অবস্থান করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের ন্যায় চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক পদধারীরা সিলেকশন গ্রেডের অনুপস্থিতিতে তাদের সমমানের পদের চেয়ে নিম্ন গ্রেডভুক্ত হওয়ার কারণে তাদের মধ্যেও ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
আগেকার বেতন স্কেলে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিভুক্তরা বর্তমান বেতন স্কেলের যথাক্রমে ১১-১৬নং এবং এবং ১৭-২০নং গ্রেডভুক্ত। এ ১০টি গ্রেডভুক্ত কর্মচারীদের অধিকাংশই পদোন্নতিযোগ্য নয় এমন পদে যোগ দিয়ে দীর্ঘ চাকরিকাল অতিবাহিত করে একই পদ থেকে অবসরগ্রহণ করতেন। কিন্তু অতীতে টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের সুবিধা থাকার কারণে তারা উচ্চতর স্কেলে ও গ্রেডে উন্নীত হওয়ার সুযোগ পেতেন। এ সুযোগের কারণে তাদের হতাশা ও ক্ষোভের প্রশমন হতো। বর্তমানে এ সকল গ্রেডে কর্মরত অনেককেই আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায়, সচিবরা যদি একই পদে কর্মরত থেকে সিনিয়র সচিব হয়ে উচ্চতর বেতন স্কেল পেতে পারেন, সেক্ষেত্রে আগেকার পিয়ন, সুইপার, নাইট গার্ড, ড্রাইভার যারা বর্তমানে অফিস সহায়ক, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, নিরাপত্তা প্রহরী, ড্রাইভার নামে অভিহিত তারা কেন সিনিয়র অফিস সহায়ক, সিনিয়র পরিচ্ছন্নতা কর্মী, সিনিয়র নিরাপত্তা প্রহরী, সিনিয়র ড্রাইভার পদে উন্নীত হয়ে উচ্চতর গ্রেডে বেতন প্রাপ্ত হবেন না?
আমাদের দেশ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছেন এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, বিদেশে কর্মরত শ্রমিক ও বিভিন্ন ব্যক্তি উদ্যোক্তা। এরা যখন দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করে চলেছেন তখন আমাদের সচিব পদধারী আমলারা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা নিয়ে উৎকণ্ঠিত। সচিব পদধারী আমলাদের নিকট হতে শ্রমিক শ্রেণিসহ ব্যক্তি উদ্যোক্তারা সঠিক দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতা পেলে এ দেশ বহু আগেই একটি সম্মানজনক স্থানে পৌঁছে যেত। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই এভাবে সুযোগ-সুবিধা ও পদমর্যাদার লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকলে সঠিক সময়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো দুরূহ হবে। আর তাই তাদের নিকট হতে দেশবাসীর প্রত্যাশা তারা যখন আইন, বিধি ও নীতি-নৈতিকতার বালাই না করে নিজেদের স্বার্থের জন্য অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলেন তখন অন্তত দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করে আইন, বিধি ও নীতি-নৈতিকতার অনুসরণে অপরাপরদের ন্যায্য প্রাপ্তির পথে যেন অযথা অন্তরায় সৃষ্টি না করেন।
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান