বাংলাদেশ-ভারত সামরিক সম্পর্ক এবং প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপট
দেশ স্বাধীনের পর থেকে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী দুটি টহল বোট পাওয়ার পর থেকে ভারতের কাছ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সরকার সামরিক সহায়তা লাভ করতে পারেনি। বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারতের জনগণের মনস্তাত্বিক দূরত্ব রয়েছে। এই দূরত্ব কোনোভাবেই দূর করা সম্ভব হয়নি। প্রতিবেশী বিশাল দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনগণের চাওয়া-পাওয়ার প্রতি ভারতের কোনো সরকার আজ পর্যন্ত সম্মান জানাতে পারেনি। যখনই বাংলাদেশের যেই সরকারই ক্ষমতায় এসেছে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে সে রকম কোনো দৃষ্টান্ত এ পর্যন্ত দেখা যায়নি। ফারাক্কা বাঁধ তৈরি কারার পর বাংলাদেশের একাধিক অঞ্চল যেমনÑ মিনি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে তেমনি একাধিক নদী মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। ভারতের কোনো সরকারই প্রতিবেশী বাংলাদেশের জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যায্য পানি দেয়নি। বারবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পানির জন্য ভারতের কাছে আবেদন জানালেও ভারত বারবার ব্যাপারটিকে দীর্ঘতর করেছে। বাংলাদেশের কৃষকরা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন, চোখের জল ফেলেছেন তারপরও ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য পানি আদায় করতে পারেনি।
বাংলাদেশি জনগণের আবেগের প্রতি ভারতীয় আমলাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই এটি বারবার প্রমাণিত হয়েছে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রতিবেশী প্রতিটি দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। দেশের সামরিক বাহিনীকে একটি চৌকস বাহিনীতে পরিণত করার জন্য নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। রাশিয়ার সঙ্গে এক সামরিক চুক্তির আওতায় রাশিয়ার কাছ থেকে বাংলাদেশ আট হাজার কোটি টাকার সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করবে। এর মধ্যে থাকবে অত্যাধুনিক ১২টি ইয়াক-১৩০ জঙ্গি বিমান, ৬টি অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারসহ নানা শ্রেণির মিসাইল। এর ফলে বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী অনেক দূর এগিয়ে যাবে। এ ছাড়া চীনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে অত্যাধুনিক এফ-৭ জঙ্গি বিমান। সেই সঙ্গে চীনের কাছ থেকে দুটি ফ্রিগেট, দুটি করভেট সংগ্রহ করা হয়েছে। খুলনায় শীপইয়ার্ড-এ বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের জন্য পেট্রলবোট নির্মাণ করা হয়েছে। চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন সংগ্রহ করা হয়েছে। জার্মানি থেকে দুটি উপকূল রক্ষীবিমান ও ইতালি থেকে দুটি উপকূল রক্ষীহেলিকপ্টার সংগ্রহ করা হয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী এখন একটি ত্রিমাতিৃক নৌবাহিনীতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চীনের তৈরি সাবমেরিন যোগ দেওয়ার পর ভারত একাধিকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বাংলাদেশ সফর করার পর ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর বাংলাদেশ সফর করেন। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফর আলোচিত সফর হিসেবে বিবেচিত হয়। ঠিক যখন বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন লাভ করল তখন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর অনেককেই উদ্বিগ্ন করেছে। এর মধ্যে ভারত বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে তারা বাংলাদেশকে পাঁচশত কোটি ডলারের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে চায়। সাধারণত প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কিছুটা তিক্ততা থাকে। প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছ থেকে বেশিরভাগ সময় সমরিক সরঞ্জাম ক্রয় করা হয় না। কিন্তু যে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের জনগণের কাছে নিজেদের বন্ধুত্বের নমুনা দেখাতে পারেনি, প্রমাণ দেখাতে পারেনি। বাংলাদেশে বৈধ অবৈধভাবে কয়েক লাখ ভারতীয় নাগরিক বসবাস করছেন। প্রতিবছর কয়েকশত কোটি ডলার তারা ভারতে পাঠাচ্ছেন। ভারতের অর্থনীতিকে উন্নত করছেন। বাংলাদেশ থেকে যেসব পর্যটক বা চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য যান তাদের প্রতি ভারতীয় দূতাবাস দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো আচরণ করেন। অথচ ভারতের কোনো নাগরিক মাত্র ১২ ঘণ্টায় কোনো ঝামেলা ছাড়া বাংলাদেশের ভিসা পেয়ে যান। ভারতের কাছ থেকে পাঁচশত কোটি ডলারের সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করা বাংলাদেশের জন্য কতটা লাভজনক হবে এটা ভাবার বিষয়। যতদূর জেনেছি, আমাদের কোস্ট গার্ড ও সীমান্ত রক্ষীদের উন্নতির জন্য ভারত সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে চায়। যে ভারত নিজেই বিদেশ থেকে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন ও ইসরাইলের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করছে তারা হঠাৎ করে বাংলাদেশের কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে চায় কেন? এই প্রশ্নটি দেখা দিয়েছে, তাছাড়া ভারতের তৈরি সামরিক সরঞ্জামের গুণগতমান ততটা উন্নত নয়। বাংলাদেশের সামরিক স্থাপনায় বিদেশি সামরিক বিশেষজ্ঞ বা গোয়েন্দাদের উপস্থিতি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, এতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে। যে ভারত আমাদের ন্যায্য পানি দিতে পারে না, সেই ভারত আমাদের সামরিক সরঞ্জাম দিতে চায় কেন? ভারত থেকে যদি আমরা সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করি তাহলে ভারতের সামরিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতি আমাদের দেশে অনেকটাই বেড়ে যাবে। এটা রাষ্ট্রের জন্য কতটা ক্ষতি কিংবা আদৌ কোনোভাবে লাভজনক কিনা তা ভেবে দেখার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে বলে মনে করি।
লেখক: কলামিস্ট/সম্পাদনা: আশিক রহমান