ঐতিহাসিক শামেলির পথে………… : মুহাম্মদ নাজমুল ইসলাম
বাজে তখন ভোর পাঁচটা। ভারতের দেওবন্দ স্টেশন। আমরা এক কাফেলা তখন গঙ্গু পরিবহনে চড়ে বসলাম। উদ্দেশ্য, যাবো ঐতিহাসিক শামেলি ময়দান। গাড়ি ছাড়লো। ধীরে ধীরে গে-ারিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের নিয়ে গাড়ি সামনে এগুচ্ছে। গাড়ির ইঞ্চি ইঞ্চি ফাঁকফোকর ভেদ করে বাইরের ঠান্ডা হাওয়া আমাদের গা ছুঁয়ে দিচ্ছে। চাদর মুড়ি দিয়ে আমরা তখন জিম মেরে বসে আছি। গাড়ি চলছে একদম ননস্টপ গতিতে অবিরাম। ঘড়ির কাটা যখন ৮টা বাসের জানালা দিয়ে দেখলাম লেখা শামেলি এলাকা। গাড়ি থেকে নামলাম। সামনে এগুলাম আর তার নয়নাভিরাম অবলোকনে আত্মার প্রশান্তি অনুভব করালাম। কিন্তু অপরদিকে অজরা অশ্রু কপালে জমাট বাধতেই লাগলো। নিজেকে আটকাতে না পেরে ক্লিক ক্লিক করে মোবাইলে দু,চারটে পিকচার তুলে ফেললাম। কিছুক্ষণ হাটলাম, দেখলাম আর ইতিহাসে পাতায় অঙ্কুরিত দু’চারটে লাইন আবছা আবছা মাথায় উপস্থিত করলাম।
বহুকাল আগের কথা। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৮৫৭ সাল। ইংরেজ সৈন্যরা দিল্লীতে মোগল সাম্রাজ্যের শেষ স্মারক সম্রাট বাহাদুর শাহ জফরকে গ্রেফতার করে, পুরো দিল্লীতে ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। দিল্লীতে ধ্বংস-লুটতরাজ চালানোর পর কিছুদিনের মধ্যে ইংরেজ সৈন্যরা বিজয়ের বেশে থানাভবনের প্রাচীরে এসে তোপ স্থাপন করে। এদিকে ইংরেজদের অধীনে চাকুরীরত দেশীয় সিপাহীদের মধ্যে বিদ্রোহের দানা বাঁধতে শুরু করে। আম জনসাধারণ বদ্ধপরিকর হয়। অবশেষে হিন্দুস্তানের ভূমি থেকে ব্যবসার নামে ভূমি দখলদারি গাদ্দার বৃটিশদের হটিয়ে দিতে এক ঝাক বুজুর্গ মুক্তিযুদ্ধা হয়ে ঘাটি বাঁধেন ঐতিহাসিক এ শামেলির ময়দানে। প্রতিজ্ঞা করলেন যুদ্ধ করে ভারতীয় আদমিদের একরাশ ভালোবাসার বন্ধন ফিরিয়ে আনতে। নিজেদের আযাদ করতে। হারানো সম্পদ এবং বৈরনির্যাতন থেকে নিজেদের মুক্ত করে হারানো স্বাধীনতা ফিরে পেতে। আকাবিরদের মিশনকে বাস্তবায়ন করে হিন্দুস্তানের ভূমিকে আযাদ করতে। আর এ সিদ্ধান্তেই একঝাক ওলামায়ে কেরাম এ ঐতিহাসিক ভূমিতে হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রাহ’র তত্ত্বাবধানে একটি বৈঠকের আয়োজন করেন। বৈঠকের এজেন্ডা ছিলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ‘জিহাদের ঘোষণা’। বৈঠকে হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেব রাহ’কে আমীর নিয়োগ করা হলো, হযরত মাওলানা কাসিম নানুতবী সাহেব রাহ’কে সেনাবাহিনীর প্রধান এবং হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ’কে নিয়োগ করা হলো কাজী (বিচার বিভাগের প্রধান)। মাওলানা মুহাম্মদ মুনীর সাহেব নানুতবী রহ. এবং হযরত হাফিয জামিন সাহেব রহ. কে ডান ও বাম পার্শ্বের অফিসার। যেহেতু আশপাশের এলাকার মধ্যে উল্লেখিত হযরতগণ ইলম ও তাক্বওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ছিলেন, এইসব হযরতগণের ইখলাস এবং খোদাভীরুতার দ্বারা অনেক লোক প্রভাবিত ছিলো, তারা সর্বদা তাঁদের দীনদারী এবং আল্লাহভীতি দেখছিলেন, এজন্য তাঁদের উপর নির্ভর করেই মিশনের ছক আকা হলো। তাছাড়া তাঁদের ছাত্র ও শিষ্যরা অভাবনীয় অনুরক্ত ছিলেন। এজন্য অল্প দিনেই দলে দলে লোকেরা এ কাফেলার অন্তর্ভুক্ত হতে শুরু করলো। তখন পর্যন্ত অস্ত্রের উপর বিধি আরোপ ছিলো না, সাধারনতঃ লোকদের কাছে অস্ত্র থাকতো, যেগুলোকে রাখা এবং এর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করাকে মুসলমানরা আবশ্যক মনে করতেন। কিন্তু এ অস্ত্রগুলো পুরাতন মডেলের ছিলো। বন্দুকসমূহ টুটাবিশিষ্ট ছিল, কার্তুজ এবং রাইফেল ছিলো না। এগুলো শুধু ইংরেজ সৈন্যদের কাছে ছিলো। যাক মুজাহিদরা সহস্রাধিক জড়ো হলেন, থানাভবন এবং আশপাশে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলো। ইংরেজদের অধিনস্ত শাসককে বের করে দেওয়া হলো। শুরু হলো তুমুল সংঘর্ষ। বুলেটের আঘাতে অন্যসব যোদ্ধাদের শোক সাগরে ভাসিয়ে নিমিশেই চলে গেলো দুই মনীষীর পবিত্র প্রাণ। শামেলীর মাটি হলো রক্তে রঙ্গিন। বাকি যোদ্ধারা এবার ফিরে পেলেন নতুন এক স্পৃহা। যুদ্ধ তিব্র থেকে তিব্র হয়ে উঠলো। দু’টি তাজা প্রাণের বিনিময়ে বিজয় হলো শামেলী। ইতিহাসের খাতায় রক্ত অশ্রু দিয়ে লিখা হলো সেই দুই শহিদান আল্লামা যামিন শহিদ ও আল্লামা আব্দুল্লাহ তানভি রহ.’র পবিত্র নামদ্বয়। সেই মাঠিতে পা ফেললাম আজ আমিও। হাটলাম আর দেখলাম। আজ আর সেই বিশাল শামেলী ময়দান বাকি নেই। মুসলমানদের হাতছাড়া বললেই চলে। কিছুটা হিন্দুরা দখল করে মন্দির বানিয়ে রেখেছে। কিছুটা জঙ্গল। আর কিছুটায় আল্লামা যামিন শহিদ রাহ.এর নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আর সেখানের ইলমের আলোকরশ্মি চারি তরফ ঝলমল করে রাখছে। আসর ছুঁই ছুঁই ময়দান থেকে বেরুলাম এবং মুখ ফিরালাম আপনালয় দেওবন্দে।