সংবিধানের অবমাননায় বৈষম্য অপ্রত্যাশিত
ইকতেদার আহমেদ
আইনের দৃষ্টিতে সমতাÑ আমাদের সংবিধানের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। আমাদের সংবিধানে এটিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ অনন্য বৈশিষ্ট্যের ওপর আমাদের সংবিধানের অন্তর্নিহিত শক্তি নিহিত। সংবিধানের এ বিধানটির প্রতি আলোকপাত করলে দেখা যায় এতে স্পষ্টত উল্লেখ রয়েছে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে সংবিধানের অবজ্ঞা ও উপেক্ষায় সকল নাগরিক যে আইনের দৃষ্টিতে সমান নয় এরূপ অনেক উদাহরণ রয়েছে। তবে নিবন্ধের কলেবর বিবেচনায় এখানে শুধুমাত্র একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখা হলো।
বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকদের অবদান অপরিসীম। প্রবাসে কর্মরত অধিকাংশ শ্রমিকই কায়ক্লেশে জীবনধারণ করে উপার্জিত অর্থের ৮০-৯০ ভাগ দেশে প্রেরণ করে থাকে। প্রবাসী শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থের কারণেই আজ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভা-ার স্ফীত। প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকরা দীর্ঘদিন প্রবাস যাপনের পর যখন ছুটি কাটাতে বাড়িতে আসে তখন বিমানবন্দরে তাদের অনেককেই তথায় কর্মরত শুল্ক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্বারা অহেতুক হয়রানির শিকার হতে হয়। প্রবাসী শ্রমিকরা শুল্ক ও বহির্গমন আইন বিষয়ে সঠিকভাবে অবহিত নয় বিধায় প্রায়শই তাদেরকে প্রবাসে যাওয়ার সময় অথবা প্রবাস হতে ফেরার সময় এদের অন্যায় আবদার রক্ষা করতে গিয়ে যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকাংশই গ্রামীণ জনপদ হতে আগত। এরা সচরাচর যৌথ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণে পরিবারের সদস্য হিসেবে এরা একে অপরের ওপর স্নেহশীল। এদের হৃদয় কোমলতায় পরিপূর্ণ। আর তাই এরা প্রবাসে যাওয়ার সময় আবার প্রবাস হতে ফেরার সময় দেখা যায় পরিবারের ৪-১২ জন সদস্য উপস্থিত থেকে বিদায় ও অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। যেকোনো বিদেশগামী যাত্রীর প্রস্থান বা আগমনের সময় অপর কেউ তার সঙ্গে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে আগমন ও প্রস্থান স্থলে প্রবেশ করতে চাইলে এরূপ প্রতিজনকে ৩০০ টাকা প্রবেশ মূল্য প্রদান করতে হয়। এভাবে দেখা যায় একজন প্রবাসী শ্রমিকের প্রস্থান ও আগমনের সময় উপস্থিতির সংখ্যাভেদে তার সামর্থ্য বিবেচনায় ভালো অংকের অর্থ ব্যয় হয় যা সরকারের রাজস্ব হিসেবে আহরিত হয়।
আমাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ পৃথিবীর সকল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিআইপি ও ভিভিআইপি লাউঞ্জ রয়েছে। পৃথিবীর উন্নত সকল ভিআইপি ও ভিভিআইপি লাউঞ্জের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থার ওপর ন্যস্ত। উন্নত দেশসমূহে রাষ্ট্রীয় সফর ব্যতীত কোনো ভিভিআইপি বা ভিআইপি অথবা অন্য যেকোনো ব্যক্তি ভিভিআইপি ও ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করতে চাইলে তাকে নির্দিষ্ট অংকের অর্থ প্রদান করতে হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশ ব্যতিক্রম। আমাদের দেশে হজরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিআইপিদের ব্যবহারের জন্য ৪টি লাউঞ্জ এবং ভিভিআইপিদের ব্যবহারের জন্য একটি পৃথক ভবনে সকল সুবিধা সম্বলিত অপর একটি লাউঞ্জ রয়েছে। আমাদের ভিভিআইপি ও ভিআইপিরা এ সকল লাউঞ্জ ব্যবহারের সময় সরকারি বা ব্যক্তিগতভাবে কোনো অর্থ প্রদান করেন না। অথচ একই ভিভিআইপি বা ভিআইপি বিদেশের যেকোনো বিমানবন্দরে এরূপ লাউঞ্জ ব্যবহার করতে চাইলে অর্থ প্রদান ব্যতিরেকে তা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে যুগ্মসচিব হতে সচিব অবধি পদমর্যাদার কর্মকর্তারা ভিআইপ হিসেবে ঘোষিত। এরূপ একজন ভিআইপির বিমানবন্দরে আগমন ও প্রস্থানের সময় দুজন ব্যক্তি লাউঞ্জের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো এমন অনেক ভিআইপির আগমন ও প্রস্থানের সময় উপস্থিত ব্যক্তির সংখ্যা ২০ বা ৩০ অতিক্রম করলেও আশ্চার্যান্বিত হতে হয় না। এ তো গেল সরকারি চাকরিজীবী ভিআইপিদের কথা। আর যদি ভিআইপি মন্ত্রী পদধারী হয় সেক্ষেত্রে উপস্থিতির সংখ্যা উল্লেখ না করে বলতে হয় অগণিত। আমাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভিভিআইপি। তারা যে কেউ রাষ্ট্রীয় সফর ব্যতীত অন্য যেকোনো ধরনের সফরে ইউরোপের কোনো দেশ বা যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চাইলে তাদেরকে নির্ধারিত পরিমাণ প্রবেশ মূল্য পরিধোধ পূর্বক ভিভিআইপি বা ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। সফরটি রাষ্ট্রীয় হলে যে দেশের আমন্ত্রণে সফরটি হচ্ছে সে দেশের সরকার লাউঞ্জ ব্যবহার সংক্রান্ত অর্থ পরিশোধ করে থাকে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই একজন যাত্রীর আগমন ও প্রস্থানকালীন তার সঙ্গে অপর কেউ আগমন ও প্রস্থান স্থলে প্রবেশ করতে পারে না। আমাদের দেশে একজন সাধারণ যাত্রীর আগমন ও প্রস্থানকালীন যে সকল ব্যক্তি নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ পূর্বক আগমন ও প্রস্থান স্থলে প্রবেশ করেন এর মাধ্যমে সরকারের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব আহরণ হয়ে থাকে। কিন্তু একজন ভিভিআইপি যাত্রীর আগমন ও প্রস্থানের সময় সরকারি আদেশের ব্যত্যয়ে অনুমোদিত নয় এমন অনেকের ভিআইপি লাউঞ্জে প্রবেশ ঘটলেও এর মাধ্যমে সরকার কোনো রাজস্ব আহরণ তো করেই না বরং অযাচিত ব্যক্তির উপস্থিতির কারণে লাউঞ্জের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। আমাদের দেশের যে যাত্রী ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করে ইউরোপ বা আমেরিকা যাচ্ছেন সেসব দেশে অবতরণ পরবর্তী সাধারণ যাত্রী হিসেবে তাকে বিমানবন্দর থেকে বের হতে হয়। অনুরূপ সেসব দেশ থেকে পুনঃ দেশে আগমনকালে সাধারণ যাত্রী হিসেবে নিজের উপস্থিতিতে সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে বিমানে আরোহণ করতে হয়।
আমাদের সাধারণ যাত্রী যাদের এক বিরাট অংশ প্রবাসে কর্মরত শ্রমিক তাদেরকে যখন আগমন ও প্রস্থানের সময় বাড়তি লোকের উপস্থিতির জন্য প্রবেশ মূল্য প্রদান করতে হয় তখন ভিআইপি যাত্রীদের আগমন ও প্রস্থানের সময় তাদের আগমন ও প্রস্থান সংশ্লেষে ভিআইপি লাউঞ্জে উপস্থিতির জন্য কোনো অর্থ পরিশোধ না করা এবং তাদের নিজের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কোনোরূপ মূল্য পরিশোধ না করা সংবিধানের মৌলিক বিধান সুযোগের সমতার পরিপন্থী। কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের অসম বিধান বা নিয়মের প্রচলন নেই। তাই দীর্ঘকাল থেকে আমাদের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংবিধানের নির্দেশনার ব্যত্যয়ে সাধারণ যাত্রী ও ভিআইপি যাত্রীদের ক্ষেত্রে যে বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়েছে এর দ্রুত অবসান প্রত্যাশিত।
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
রশঃবফবৎধযসবফ@ুধযড়ড়.পড়স
সম্পাদনা: আশিক রহমান