পলাতক যুদ্ধাপরাধীর জমি বিক্রি!
রাশিদ রিয়াজ : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৌলভি জাকারিয়া সিকদারের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীর অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর থেকে গত ২ বছর ধরে তিনি পলাতক। কিন্তু পলাতক থেকেও তিনি তার আত্মীয় স্বজনের কাছে জমি হস্তান্তর বা বিক্রি করেছেন। আর তা সম্ভব হয়েছে সাব রেজিস্ট্রার অফিসের সহযোগিতার কারণে। এক্ষেত্রে আইনের একটি বিশেষ সুবিধা কাজে লাগিয়েছেন মৌলভি জাকারিয়া সিকদার।
পুলিশের ব্যর্থতায় কক্সবাজারের বাসিন্দা ৭৮ বছর বয়ষ্ক মৌলভি জাকারিয়াকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তিনি তার ৩৮ লাখ টাকা মূল্যের সম্পত্তি মেয়েদের নামে গত বছর নভেম্বর মাসে হেবা দলিলের মাধ্যমে দান করে দিয়েছেন। মহেশখালি উপজেলার সাব রেজিস্ট্রার অফিস এ হস্তান্তরে সাহায্য করেছে।
বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা জানতে পেরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ পাঠায়। এ নির্দেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও কক্সবাজারে পুলিশ প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছে। নির্দেশ সম্বলিত এ চিঠিতে বলা হয়েছে মহেশখালি উপজেলার গোরাকঘাটা সিকদারপাড়ার জাকারিয়া তার সম্পত্তি হস্তান্তর করেছে এবং মামলার রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীকে প্রভাবিত করা হয়েছে। জমি রেজিস্ট্রেশনের অন্যান্য দলিলাদিও সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়েছে।
২০১৫ সালের ২১ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মহেশখালির ১৬ জন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এদের মধ্যে জাকারিয়া ছিলেন অন্যতম। পুলিশ ৩ জনকে গ্রেফতার করতে পারলেও জাকারিয়া এখনো পলাতক। ২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের তদন্ত শেষে এ মামলায় জাকারিয়াসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯৪ জনকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। গত বছরের ১৫ মার্চ তাদের মধ্যে ১২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়। এরই মধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালকে দেওয়া প্রতিবেদনে আসামিদের পলাতক দেখানো হয়েছে। সর্বশেষ প্রতিবেদনটি দেওয়া হয় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে জাকারিয়া তার ঠাকুরতলা মৌজার শূন্য দশমিক ৯৯৭৫ একর জমি চার মেয়ে মায়মুনা সাওদা,খালেদা বেগম, শাগেদা খানম ও রোকসানা আখতারকে হ্যাবা দলিলে দান করেছেন। এ দলিল সম্পন্ন করেছেন মহেশখালি উপজিলা সাব-রেজিস্টার গৌরাঙ্গ চন্দ্র দেবনাথ। ১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের ৩১ ধারা বলে তা করা হয়েছে। গৌরাঙ্গ গত ১০ নভেম্বর চট্টগ্রামে জাকারিয়ার আত্মীয়ের বাসায় যান। তবে হ্যাবা দলিলে কোনো সুনির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। সাধারণত ও আইন অনুযায়ী হ্যাবা দলিল সম্পন্ন করার সময় জমির মালিককে সাব রেজিস্ট্রার অফিসে সশরীরে উপস্থিত থাকতে হয়। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে এর ব্যতিক্রম হতে পারে। সেক্ষেত্রে একজন অনুমোদিত কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা প্রয়োজন হবে। যিনি ওই জমি ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে কথা বলে রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজনীয় তথ্য পূরণ ও নিয়ম মেনে চলবেন। যুদ্ধাপরাধী জাকারিয়া এক্ষেত্রে অসুস্থতার কারণ দেখিয়েছেন।
মহেশখালি উপজিলা সাব-রেজিস্ট্রার গৌরাঙ্গ চন্দ্র দেবনাথ জানান তিনি গত জুন মাসে মহেশখালি বদলি হয়ে যান এবং তিনি জানতেন না জাকারিয়া একজন পলাতক যুদ্ধাপরাধী। পলাতক জানলে এ ধরনের জমি হস্তান্তরের কোনো সুযোগ নেই। একমাস আগে ইউএনও স্যার আমাকে জানান, জাকারিয়া একজন যুদ্ধাপরাধী। যদি আমি পূর্বেই তা জানতাম তাহলে জমি হস্তান্তরের কোনো সম্ভাবনাই থাকত না। আমি কখনো তা করতাম না।
কিন্তু জাকারিয়ার জমি হস্তান্তরের দলিলে ঠিকানা পুরোপুরি না থাকার পরও কেন গৌরাঙ্গ তা রেজিস্ট্রি করে দিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে সাধারণত এ ধরনের রেজিস্ট্রির ক্ষেত্রে পূর্ণ ঠিকানা উল্লেখ থাকে।
এদিকে মহেশখালি থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস জানান, তারা জাকারিয়াকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ অনুযায়ী তদন্তে তারা দেখতে পেয়েছেন জাকারিয়ার দ্বিতল একটি বাড়ি আছে। জমি হস্তান্তরের বিষয়ে স্থানীয় এসি ল্যান্ড অফিস থেকে কোনো নির্দেশনা তারা পাননি বলেও প্রদীপ জানান।
জাকারিয়ার মতো অন্যান্য পলাতক যুদ্ধাপরাধী তাদের জমি বিক্রির সুযোগ নিতে পারেন। এ ধরনের পলাতক যুদ্ধাপরাধীর সংখ্যা ৭৫। পলাতক যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আজাদ যিনি বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত, এম এ জাহিদ হোসেন খোকন, আব্দুল জাব্বার, লিয়াকত আলির মতো অনেক পলাতক যুদ্ধাপরাধী তাদের জমি বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারেন। ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছে এসব যুদ্ধাপরাধীর অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং অন্যান্য সম্পত্তি রয়েছে যা থেকে রীতিমতো আয় করছেন এবং নির্বিঘেœ জীবন অতিবাহিত করছেন। এদের অনেকে নাশকতামূলক কর্মকা-ে জড়িত আছেন। এজন্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে আইনে সংশোধন প্রয়োজন যাতে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই তাদের গ্রেফতার করা যেতে পারে। কিন্তু আইন না থাকায় পলাতক থেকেও যুদ্ধাপরাধীরা তাদের আত্মীয় স্বজনদের মাধ্যমে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পলাতক যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা সাব রেজিস্ট্রার অফিস, স্টক এক্সচেঞ্জ, অফিস অব দি রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিস অ্যান্ড ফার্মে দেওয়া উচিত যাতে তারা কোনো সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করতে না পারেন। ডেইলি স্টার থেকে অনুবাদ। সম্পাদনা: শিমুল মাহমুদ