শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন জানে না কীভাবে সমন্বয় হবে? কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা স্বীকৃতির আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়নি
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী : কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ও সনদের স্বীকৃতি দেওয়ার আগে এই বিষয়ে যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি। এমনকি যে বিষয়ের সঙ্গে মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে তাতে করে ২০১০ সালে যে জাতীয় শিক্ষানীতি করা হয়েছে এর সঙ্গে এর সমন্বয় নেই। বরং ওই নীতিমালাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এই শিক্ষাকে বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসার দাওরা-ই হাদিসকে সাধারণ শিক্ষার মাস্টার্স সনদের সমমানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এটা রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এদিকে এই সনদ মাস্টার্স সমমানের হওয়ার কারণে কিভাবে মূল লেখাপড়ার সঙ্গে এটি সমন্বয় করা হবে সেই ব্যাপারেও দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এভাবে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যালোচনা ও গবেষণা ছাড়াই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে এ নিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সূত্র জানায়, সরকার কওমি মাদ্রাসার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। আর তা করার জন্য যে ধরনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা দরকার ছিল তা করা হয়নি। এমনকি কওমি মাদ্রাসার এখন যে শিক্ষা পদ্ধতি রয়েছে তা সংস্কারও করা হয়নি। এই অবস্থায় এই শিক্ষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
কওমি মাদ্রাসায় কারা পড়ে, তাদের সংখ্যা কত, স্টুডেন্ট কেমন, যারা পড়াচ্ছেন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কি, আর কি কি পড়ানো হচ্ছে। মূল শিক্ষার সঙ্গে তাদের সিলেবাসের কি কি পার্থক্য রয়েছে। সেই সঙ্গে এসব মাদ্রাসা চালানোর জন্য খরচ, এসব খরচ কোথা থেকে আসছে এবং কেমন করে বহন করা হচ্ছে। এছাড়া এই লাইনে কত সংখ্যক প্রতিষ্ঠান আছে, টিচার কতজন আছেন, এই বিষয়ে যথাযথভাবে যে তথ্য সংগ্রহ করা দরকার ছিল তা করা হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে ও সরকারের কাছেও সুনির্দিষ্ট করে এসব তথ্য নেই। কওমি মাদ্রাসাগুলো কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যেসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে সেসব তথ্যই রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি হিসাব আছে তাও দুই বছর আগের।
সূত্র জানায়, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে সরকার স্বীকৃতি দিতে চাইলে আগে এ নিয়ে কাজ করা দরকার ছিল। সংস্কার করারও দরকার ছিল। কিন্তু সেই সংস্কার করা হয়নি। তা না করার কারণে সমস্যা বেড়েছে।
এদিকে সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাতিল করার জন্য দাবি জানিয়েছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত। তারা মানববন্ধন, বিক্ষোভ করবে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও দিবে। তাদের দেখাদেখি অন্যরাও এ ব্যাপারে আপত্তি তুলতে পারে। বিশেষ করে আলিয়া মাদ্রাসাগুলো। কওমি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ সরকারি আনুগত্য ও সরকারি নিয়ম মানে না। শিক্ষা কার্যক্রম সরকার অনুমোদিত নয়। তারপরও তাদেরকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি রহস্যজনক। ২০১২ সালে যে ‘কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করা হয়েছিল তখন ওই শিক্ষাব্যবস্থার স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ গঠন করার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু তা হয়নি। কারণ বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদে উত্থাপনের পর সেখানে সরকারের প্রতিনিধি থাকার বিষয়টি তারা মনে না নেওয়ায় আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখন সরাসরি তাদেরকে স্বীকৃতি দেওয়া হলো।
সরকার গত বৃহস্পতিবার রাত ৯টার পর দাওরা-ই হাদিসকে সাধারণ শিক্ষার মাস্টার্স সনদের সমমানের স্বীকৃতি দিয়ে হঠাৎ করেই প্রজ্ঞাপন জারি করে। তবে এই প্রজ্ঞাপন জারি করার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, তাদের কাছে যে রকম নির্দেশনা এসেছে সে অনুযায়ী একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সেখানে তার পক্ষে কোনো কিছু বলা সম্ভব নয়। সূত্র জানায়, এই প্রজ্ঞাপনটি রাতের বেলা তড়িঘড়ি করে করার কেন দরকার হলো তাও বোঝা গেল না। সবসময় দেখা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য মন্ত্রণালয় অতি গুরুত্বপূর্ণ কিংবা জনগুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলে রাতের বেলায় প্রজ্ঞাপন জারি করে। না হলে সাধারণত দিনের বেলাই হয়। এখানে তা হয়নি। রাতের বেলায়ই করা হলো।
এখন যে তাদেরকে মাস্টার্সের স্বীকৃতি দেওয়া হবে এতে করে সনদের স্বীকৃতি নিয়ে জটিলতা তৈরি হবে। কারণ অন্যান্য মাধ্যমে যত বছর পড়ে মাস্টার্স সার্টিফিকেট পেতে হয়, এখানে সেটা হবে না। সেই সঙ্গে এখানে অনেকে কম পড়েই মাস্টার্স সনদ পাবে। আর তারা চাকরিও পাবে। এতে করে সহজেই স্টুডেন্টরা মাস্টার্স সনদ পাওয়ার জন্য এই লাইনে লেখাপড়া করায় উদ্বুদ্ধ হতে পারে। তাতে করে আগামী দিনে একটি সমস্যা তৈরি হবে। এছাড়া ধর্মীয় অন্যান্য যেসব লেখাপড়া ও কারিকুলাম রয়েছে তারাও এ নিয়ে আপত্তি করবে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কওমি মাদ্রাসার নেতারা চান তাদের শিক্ষাকে মূলধারার সঙ্গে আনতে। সেটা সরকারের মতো হলে হবে না। তাদের মনের মতো হতে হবে। আবার তারা যে মূলধারার সঙ্গে আসতে চাইছে সেটাও সম্ভব না। কারণ যখন শিক্ষানীতি করা হয়েছিল তখন বলা হয়েছিল সব ধরনের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষানীতিতে নিবন্ধন করাতে হবে। কওমি মাদ্রাসা এ ব্যাপারে কোনো নিবন্ধন করায়নি। তাদের নিবন্ধন না থাকার কারণে সমস্যা হবে। তারা নিবন্ধন চায় না। এখানে শিক্ষানীতির ব্যত্যয় হয়েছে। আর এই শিক্ষাগ্রহণ করার পর যে তাদেরকে মাস্টার্স এর সার্টিফিকেট দিতে হবে সেটাতে এখন অনেকেই বলছে চাকরি পাবে না। কিংবা গুরুত্ব দেওয়া হবে না। কিন্তু সরকার যখন সার্টিফিকেট দেওয়ার কথা বলছে তখন এটাকে তারা পাস কাটাবে কেমন করে। তারা সার্টিফিকেট পাওয়ার পর যখন মূলধারা শিক্ষার সঙ্গে সমন্বয় রেখে চাকরি পাবে না তখন নতুন সমস্যা তৈরি হবে। আজকে যে বিষয়টি সহজ মনে হচ্ছে এটা এত সহজ হবে না।
বর্তমানে দেশে যে নিয়ম রয়েছে তাতে সরকার আলিয়া মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণ করে। কওমি মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণ করে না। করতে পারে না। তারা সনদ পাবে আর আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা একই সময় পড়ালেখা করে সমমানের সার্টিফিকেট পাবে না, তখন তো সমস্যা বাড়বে। চলমান ব্যবস্থায় শিক্ষাবোর্ড এইচএসসি পর্যায়ের পরীক্ষার সার্টিফিকটে দেয়। এরপর স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি দেয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সরকারের এই সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। কিন্তু কওমি মাদ্রাসা বোর্ড এখন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দিবে।
শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ মনে করছেন, দেশে কোনো শিক্ষা ব্যবস্থাই নেই। নানা রকম শিক্ষাব্যবস্থা চলছে। যখন যে দায়িত্ব পালন করছে তারা শিক্ষাকে সেভাবে ব্যবহার করে। এখনো এর ব্যতিক্রম হয়নি। এখন যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ও তাদের দাবি মেনে নিয়েছে সরকার তাতে করে এটা আগামী দিনের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে। কারণ পাঠ্যপুস্তক ও সিলেবাসে সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হতে পারে। সেটা হলে পরিস্থিতি খারাপ হবে। কেননা তাদের স্বীকৃতি দেওয়ার রেশ ধরেই যেসব শিক্ষাব্যবস্থার উপর সরকারের এখনো নিয়ন্ত্রণ নেই তারা মাস্টার্স-এর সমমানের সার্টিফিকেট চাইতে পারে।