ইসলামে সুদমুক্ত ব্যাংক ও বীমার নীতিমালা
কাজী মোরতুজা আলী
ইসলামি ব্যাংকিং ও ইসলামি ইন্স্যুরেন্স হচ্ছে ইসলামি শরীয়া মোতাবেক পরিচালিত আধুনিক ব্যাংক ও বীমা ব্যবস্থা। কুরআন, সুন্নাহ, ও ফিকাহ দ্বারা নির্দেশিত নীতিমালা অনুসারে ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স ব্যবসা পরিচালনা করাই হচ্ছে উভয় সেক্টরের আদর্শগত মূল ভিত্তি। অনেকেই এই ধারণা করে থাকে যে ইসলামের নিজস্ব কোন অর্থনৈতিক পদ্ধতি নেই। এই ধারণাটি সঠিক নয়। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থাপনা কি হবে তা ইসলামি শরীয়ায় সুষ্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। যেমন সুদ ভিত্তিক আর্থিক লেনদেন ইসলাম অনুমোদন করে না। আর্থিক লেন-দেনে অসচ্ছতা ও জুয়ার সংমিশ্রন ঘটলে আর্থিক লেন-দেন বৈধ হয় না। আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে হালাল ও হারাম এর বিধান অবশ্যই মেনে চলা জরুরি। এই কারণে কুরআন, সুন্নাহ ও ফিকাহ শাস্ত্রে যে সব বিষয়কে বৈধতা দেয়নি তার কোনটিই ব্যাংক ও বীমা ব্যবস্থায় বহাল থাকলে তাকে ইসলামি ব্যাংক বা ইসলামি বীমা বলা যায় না। ইসলামি বীমা ব্যবস্থায় আর্থিক লেনদেন বা বিনিয়োগ করা হয় শারীয়াহ অনুমোদিত পথ ও পদ্ধতিতে। এসব পদ্ধতি হচ্ছে মুশারাকা, মুদারাবা, বাই মুয়াজ্জল, ইসতিসনা, সালাম, জুয়ালা ইত্যাদি। এগুলি নেহায়েত কোন শব্দ নয় এগুলি এক একটি পদ্ধতির নাম।
ইসলামি ইন্স্যুরেন্স এর গুরুত্ব খুব অল্প কথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন পদ্ধতি এ কথা যারা স্বীকার করেন, তাদের পক্ষে এটি বোঝা সহজ যে ব্যাংক ও বীমা ব্যবস্থায় ইসলামি নীতিমালা তথা শরীয়ার বিধি বিধান প্রয়োগ করা জরুরি। শরীয়াহ অনুমোদন করে না এমন কোন বিষয় যদি ব্যাংক ও বীমা ব্যবস্থায় থাকে তবে তা ইসলামি হতে পারে না। ইসলামের উৎস “কুরআন” মহান আল্লাহর বাণী ও দিক-নির্দেশিকা। কুরআনের বিধানসমূহ এবং মহানবীর (সা.) জীবনাচরণ আদেশ অনুসরণ করা মুসলিমদের জন্য অবশ্য পালনীয়। কারণ তারা বিশ্বাস করেন যে মহান আল্লাহর বিধান ও মহানবী (সা.) এর সুন্নাহ মানুষের জন্য সবচাইতে কল্যাণকর। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য যে সব বিধান দিয়েছেন তা সমগ্র মানবতার জন্য কল্যাণকর বলেই তা অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি। মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি ও শান্তির জন্য ইসলামের বিকল্প নেই। অতএব, ইসলাম আমাদের জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ তা অস্বীকার করা যায় না। বীমা ব্যবস্থাকে আমাদের বিচার করতে হবে যে তা মানুষের জন্য কল্যাণকর কি না। ব্যাংক এবং বীমা, সঞ্চয় ও আর্থিক নিরাপত্তা প্রদানের একটি পদ্ধতি। কিন্তু ইসলামের কল্যাণময়ী বিধানের পরিপূর্ণ প্রতিফলন এখানে ঘটেনি। তাই, গারার, রীবা ও মাইসির (অস্পষ্টতা, সুদ ও জুয়া) মুক্ত ব্যাংক ও বীমা চালু করা প্রয়োজন।
ইসলামী বীমা মূলত এক ধরনের সমবায়ী পদ্ধতি যার মূল ভিত্তি হচ্ছে “সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে”। একজনের বিপদে ও অসহায় অবস্থায় সবাই মিলে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার পদ্ধতি হচ্ছে তাকাফুল বা ইসলামী বীমা। ইসলামী বীমার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের ও অপরের কল্যাণ। কল্যাণময় এই পদ্ধতি ইসলামের কল্যাণময় জীবন পদ্ধতির সাথে অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং কোনক্রমেই তা সাংঘর্ষিক নয়। ইসলামী চেতনা, মূল্যবোধ ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটেছে এই পদ্ধতিতে তাই মুসলিম অমুসলিম, ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবার জন্য তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাকাফুল বা ইসলামি বীমার উদ্ভব, বিকাশ ও বিস্তৃতি একেকভাবে ঘটেছে। যেমন ধরা যাক সুদানে প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইসলামি বীমা জন্ম লাভ করে ১৯৭৯ সালে। বর্তমানে বিশ্ব তাকাফুল বাজারে সুদানের অবস্থান ২% এর কম। মিশরের অবদান বর্তমানে ১% এর কাছাকাছি। আফ্রিকায় অন্যান্য যেসব দেশে তাকাফুল বা ইসলামি বীমা চালু হয়েছে এবং ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে সেগুলো হচ্ছে আলজেরিয়া, নাইজেরিয়া, লিবিয়া, মৌরিতানিয়া, কেনিয়া, সেনেগাল ইত্যাদি।
বাংলাদেশে তাকাফুলের বয়স প্রায় ১৬ বছর। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবদান ১% এর কিছু বেশি হতে পারে। একক দেশ হিসেবে ইসলামি বীমায় সর্বোচ্চ অবদান ইরানের যা ৪০% এর বেশি। ইরানে সকল আর্থিক লেনদেন সুদমুক্ত এবং সেই হিসেবে সুদমুক্ত ইসলামি বীমা ব্যবস্থা চালু রয়েছে, তবে সেখানে তাকাফুল পদ্ধতি চালু নেই। দূর প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। বিশ্ব তাকাফুলে মালয়েশিয়ার অবদান (+১০%)। এর পরে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া ৪%। অমুসলিম দেশ যেমন ঃ সিংগাপুর, থাইল্যান্ড এবং শ্রীলংকায় তাকাফুল ব্যবস্থা চালু হয়েছে এবং সফলতার সাথে বাজার সম্প্রসারণ ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্যের জি.সি.সিভুক্ত ছয়টি দেশের মধ্যে তাকাফুল বিশ্ব বাজারে সর্বোচ্চ অবদান সউদি আরবের যা প্রায় ৩০%।
এর পরের অবস্থান সংযুক্ত আরব আমিরাতের যা বিশ্ব তাকাফুলের প্রায় ৬%। এই অঞ্চলের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দেশ হেচ্ছ কুয়েত, কাতার এবং বাহরাইন। মুসলিমপ্রধান দেশ ইউরোপের তুরস্কে তাকাফুল ক্রমান্বয়ে যথেষ্ট বিকাশ লাভ করেছে এবং তাকাফুলের সম্ভাবনাময় বাজার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
লেখক : প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লি:-এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বর্তমান প্রধান পরামর্শক