হাওরপাড়ে কৃষকের কান্না
নুর উদ্দিন, ছাতক (সুনামগঞ্জ): ফসলহারা কৃষকদের কান্না থামছে না। সরকার থেকে সাহায্যের ঘোষণা দেয়া হলেও হাওরপাড়ের কৃষকরা দিশেহারা কিভাবে সময় পার করবেন সারা বছর সেই চিন্তায়। টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে পাউবোর বাঁধ ভেঙে জেলার সবকটি হাওর তলিয়ে গেছে। রোববার তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর ও সর্বশেষ সোমবার জামালগঞ্জ উপজেলার পাকনার হাওর তলিয়ে যায়। কৃষক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, পাউবো, ঠিকাদার ও পিআইসির লুটপাটের কারণে বরাবরের মত এবারও ফসলহানির ঘটনা ঘটে। আর অসময়ে এই ফসলহানির কারণে পানির গুনাগুন নষ্ট হয়ে হাওরের মাছ, হাঁস মরে পচে পানিতে দুর্গন্ধ দেখা দেয়।
ছাতকে নাইন্দার হাওরের পানিতে ডুব দিয়ে খাদ্য খাওয়ায় বিষাক্ত গ্যাসে অসুস্থ্য হয়ে একই মালিকের প্রায় ৫লক্ষাধিক টাকা মূল্যের ৬টি মহিষ মারা গেছে। নোয়ারাই ইউনিয়নের বাতিরকান্দি গ্রামে সোমবার লিলু মিয়ার ৩টি মহিষ মারা যায়। এর আগে দু’দিনে আরো ৩টিসহ মোট ৬টি মহিষ মারা যায়। যা- ছিল পরিবারের একমাত্র সম্বল। খাদ্য খেয়ে মহিষ মারা যাওয়া এলাকার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বাতিরকান্দি গ্রামে গোলাম মোস্তফা ও আলতাফ মিয়া তালুকদার জানান, ৭টি মহিষের মধ্যে ৬টিই মারা যাওয়ায় পরিবারের অপূরনীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। হাওরের ঘাস খেতে গিয়ে এগুলো মারা যায়। এলাকার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন মহিষ মারা যাওয়াতে। উপজেলা প্রাণী সম্পদ বিভাগের ভেটেরিনারি সার্জন (ডেইরী এন্ড পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞ) ডাক্তার আবদুস শহিদ হোসেন বলেন, দুষিত কোন পদার্থের জন্যেই মহিষ মারা যেতে পারে। তবে এব্যাপারে আরো উচ্চ পর্যায়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার এলাকার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে এলাকার । মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। দক্ষিণ সুনামগঞ্জের রনশি গ্রামের বাসিন্দা রুনা বেগম জানান, দেখার হাওরে ১৫ কিয়ার জমি চাষাবাদ করিয়েছিলেন। জমির কাঁচা সব ধান পানিতে তলিয়ে যায়। খড় না থাকায় গরুকে খাওয়ানো যাচ্ছে না। এজন্য গরু বিক্রি করে দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার পলাশ ইউনিয়নের ধরেরপাড় গ্রামের ৬৫বছর বয়সী আম্বিয়া বেগম মাছ ধরতে ধরতে বলেন, দেখইন না সব ধান গেছেগি। ৫ পুয়া-পুরি থাকলেও ঘরে অভাব আছে, নাতি লইয়্যা মাছ ধরাত আইছি। শুধু আম্বিয়া বেগম না ধরেরপাড় গ্রামের অবস্থাশালী কৃষক আবিদুর রহমানেরও একই কথা। তিনি বলেন, ছয় হাল জমি রুইছলাম, সব গেছেগি, রাইত ঘুমে ধরে না। ঘরের সামনে রাইছ মিলও বন্ধ করিলিছি। ধান নাই মিল দি কিতা করতাম। তার ভাই তালাত মিয়ার একই অবস্থা। গরু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। কেউ তার গরু গুলো কিনছে না। ঘরে খাবার না থাকায় নদীতে বালু উত্তোলনের কাজ করতে গেলেও শ্রমিক বেশি থাকায় কাজও পাচ্ছেন না। ধরেরপাড়, পাশের জনতাবাজার সহ বেশ কয়েকটি ফসলহারা মানুষ ঘরে খাবার না থাকায় অনেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজের খোঁজে চলে যাচ্ছেন।
আফলাতুন নেছা এনজিও’র কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন ২০ হাজার টাকা। মনে করেছিলেন ধান উঠার পরই সব টাকা শোধ করে দিবেন। কিন্তু সোনার ফসল ডুবে যাওয়ায় তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার এক ছেলে, লেখাপড়া করতো, এই অবস্থায় তাকে ময়মনসিংহে পাঠিয়ে দিয়েছি কারখানায় কাজ করতে। তাছাড়া তো কোনো উপায় ছিল না। শিল্পী রায় বলেন, ৮ কিয়ার জমি আছিল, অখন আওরর তলে, অখন বাচ্চার বাপে ঠেলাগাড়ি ছালাইরা তিন দিন ধরি। কিলা যে বছর যাইবো ভগবান জানে।সম্পাদনা: মুরাদ হাসান