সংবিধানে সংরক্ষিত মহিলা আসন থাকছে সরাসরি নির্বাচন নাকি বর্তমান বিধানেই থাকবে পর্যালোচনা করছে সরকার
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী : চলতি সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানের সংরক্ষিত মহিলা আসনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে না। আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনের আগেই তা শেষ হতে পারে। কারণ ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। আগামীতে সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসন রাখতে হলে সংবিধানে সংশোধনী আনতে হবে। দুই তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যদের ভোটেই তা করতে হবে। এই ব্যাপারে এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি এই সংক্রান্ত বিলটি কবে সংসদে আনা হবে। কারণ সরকার বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করছে। সংরক্ষিত আসন রাখা হলেও সরাসরি নির্বাচন করার ব্যবস্থা চালু করা হবে নাকি আগামী দুই মেয়াদ সংরক্ষিত আসন রেখে বর্তমান বিধান রেখে মেয়াদ বাড়ানো হবে। এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সরকারের নীতি নির্ধারনী একটি সূত্র জানায়, সংবিধানের সংশোধনী এনেই সংরক্ষিত নারী আসনের বিষয়টি আগামী দিনের জন্য বহাল করা হতে পারে। তবে ওই আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধান করা হবে নাকি এখনকার বিধানের মেয়াদ বাড়ানো হবে সেটা ঠিক করা হবে। আর যদি এখনকার বিধান রেখেই মেয়াদ বাড়ানো হয় সেক্ষেত্রে ক’টি সংসদের জন্য মেয়াদ বাড়ানো হবে সেটা নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সূত্র জানায়, এই বিষয়ে আইনমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলবেন। প্রধানমন্ত্রী যেই ধরণের সিদ্ধান্ত দিবেন সেই হিসাবে সংশোধনী আনা হবে।
আইনমন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এটি আলোচনা করা হবে। সেই হিসাবে কাজ করা হবে। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এটা সরকার চাইলেই সংবিধানে মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে মেয়াদ বাড়াতে পারে। সেটা কোন সমস্যা নয়। এই ব্যাপারে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এই আসন কি স্থায়ীভাবে সব সময়ের জন্য রাখতে চায়, নাকি আরও দুই মেয়াদের জন্য রাখতে চায় সেটাও দেখতে হবে। সেই হিসাবে আলোচনা করেই সংবিধান সংশোধনী করতে হবে। বর্তমানে সংবিধানে ৬৫ এর (৩) এ বলা আছে, সংবিধান (চতুর্দশ সংশোধন) আইন, ২০০৪ প্রবর্তনকালে বিদ্যমান সংসদের অব্যবহিত পরবর্তী সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে শুরু করিয়া দশ বৎসর কাল অতিবাহিত হইবার অব্যবহিত পরবর্তীকালে সংসদ ভাংগিয়া না যাওয়া পর্যন্ত ২[পঞ্চাশটি আসন] কেবল মহিলা-সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকিবে এবং তাঁহারা আইনানুযায়ী পূর্বোক্ত সদস্যদের দ্বারা সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হইবেন তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার কোন কিছুই এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন কোন আসনে কোন মহিলার নির্বাচন নিবৃত্ত করিবে না ৩[ (৩ক) সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ প্রবর্তনকালে বিদ্যমান সংসদের অবশিষ্ট মেয়াদে এই অনুচ্ছেদের (২) দফায় বর্ণিত প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত তিন শত সদস্য এবং (৩) দফায় বর্ণিত পঞ্চাশ মহিলা-সদস্য লইয়া সংসদ গঠিত হইবে।] (৪) রাজধানীতে সংসদের আসন থাকিবে। যখন এই বিধান করা হয়েছিল তখনই নারী নেত্রীরা দাবি করেছিলেন, দল কর্তৃক বাছাই করার বিধান না করে সংরক্ষিত আসন রেখে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হোক। সেই হিসাবে বিএনপি দুই সংসদের মেয়াদের জন্য নিয়ম করেছিল।
২০১১ সালে যখন আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে ৫০টি করা হলো তখন মেয়াদ বাড়ানোর দরকার ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই সময়ে এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সেটা করতে পারতো। কিন্তু না করলেও সমস্যা নেই। এই ব্যাপারে এখন করতে পারবে। চলতি সংসদের মেয়াদ এখনও দেড় বছরের বেশি সময় রয়েছে। এই অবস্থায় এর আগেই করা সম্ভব হবে। পরবর্তী সংসদের প্রথম অধিবেশনেও করতে পারে।
সরকারের একজন মন্ত্রী বলেন, সংবিধানে সংরক্ষিত আসন আপাতত থাকবে সেই রকমই চিন্তাভাবনা রয়েছে। এর মেয়াদ কত দিন করা হবে, সেটা ঠিক করেই এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনে ভাইস চেয়ারম্যান, কাউন্সিলররা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হচ্ছেন। সংসদেও তেমন করার বিষয়টি আলোচনায় প্রাধান্য পাবে। সব দিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিএনপির সূত্র জানায়, ২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে সংবিধানে নারী সংসদ সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সংরক্ষিত আসনে আসন সংখ্যা বাড়ানো হয়। ওই সময়ে নিয়ম করা হয় এটা দুই মেয়াদের জন্য করা হবে। সেই হিসাবে করা হয়। ২০১৪ সালে নির্বাচনের পর যে সংসদ গঠিত হয় সেখানেই এই কারণে নারী সংসদ সদস্যরা রয়েছেন। ২০১৮ এর শেষভাগে কিংবা ২০১৯ সালের প্রথম সপ্তাহে যে সংসদ নির্বাচন হবে ওই সংসদ নির্বাচনের পর সংরক্ষিত আসন রাখা হবে কিনা ও কত আসন করা হবে তা নিয়ে আলোচনা করার দরকার আছে। বিএনপি ওই সময় বেঁেধ দিয়েছিল কারণ বিএনপি মনে করেছিল দেশে সময় এসেছে সরাসরি নারীদের সংসদে নির্বাচন করে জয়ী হয়ে আসার। এই কারণে সংরক্ষিত আসন বাছাই করার বিষয়টি দুই মেয়াদের পর প্রয়োজন হবে না। সরাসরি নির্বাচন করার ব্যবস্থা করা যাবে। এখনও তারা প্রয়োজন আছে মনে করেন কিনা জানতে চাইলে, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান বলেন, সংবিধানে সংরক্ষিত আসন আরও রাখা দরকার আছে। তবে সেটা কত দিন এই বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে। আসন সংখ্যা ৫০ই থাকবে কিনা সেটাও আলোচনা করতে হবে। সরাসরি নির্বাচনের বিধানের বিষয়টি আলোচনা হতে পারে। সব দলের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, আমি মনে করি সংরক্ষিত আসন রাখা না রাখার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করবে। তবে তারা চাইলে রাখতে পারে। এই ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটার প্রয়োজন সম্পর্কে বলেন, সরাসরি নারীরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। সেখানে কোন বাঁধা নেই। তবে অনেক সময় যোগ্য নারী প্রার্থী পাওয়া যায় না। তা না পাওয়া গেলে দল দিতে পারে না। আবার অনেক সময় এমনও হয় যোগ্য নারী আছে কিন্তু দল প্রার্থী দিতে চায় না। এক একটি আসনের রাজনৈতিক হিসাব এবং প্রার্থী দেওয়ার বিষয়টি দলকে বিবেচনা করতে হয় সেইভাবেই। এই অবস্থায় দলকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যেভাবেই হোক আসনটি তার দলের জন্য আনতে। এই জন্য বিরোধি দলের প্রার্থীর যোগ্যতাও বিচার করা হয় প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে। এই ব্যাপারে তিনি বলেন, নারী সংরক্ষিত আসন আমি মনে করি থাকতে পারে। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে সরকার বিবেচনা করবে।
সূত্র জানায়, এই মেয়াদে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধন জোটের দুই তৃতীয়াংশ এর বেশি আসন রয়েছে। সেই হিসাবে তারা চাইলে এই সংসদে এই সংক্রান্ত বিল পাস করতে পারে। সেটা করা হলে আগামী সংসদে নারী আসন থাকবে। কিন্তু যদি সরকার এখন ব্যবস্থা না নেয় তাহলে চাইলে পরর্বতী নির্বাচনের পরেও করতে পারে। কিন্তু সেটা করতে হলে এই জন্য যে বিল পাস করার দরকার হবে সেই জন্য ওই সময়ের সরকারি দলে দুই তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন পড়বে। সরকারি দলের যদি এককভাবে তা না থাকে তাহলে সেই ক্ষেত্রে বিরোধি দলের সমর্থন প্রয়োজন হবে। সেটা না পেলে সংসদে সংরক্ষিত আসন বহাল রাখার বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে।
সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদ এ ৫০ জন নারী সংসদ সদস্য রাখার বিধান করা হয়। সেই হিসাবে এখন সংসদে ৫০ জন সংরক্ষিত নারী সদস্য রয়েছে। তাদের মেয়াদ শেষ হবে এই সংসরে মেয়াদ মেষ হওয়ার মধ্য দিয়েই।
বর্তমানে ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচন হয়। তাদের নিয়ে সংসদ গঠিত হয়। আর ৫০টি আসনে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচন করা হয় দলের প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে। বিএনপি ক্ষমাসীন অবস্থায় ২০০৪ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন করে। সেখানে সংরক্ষিত নারী সদস্যের জন্য ৪৫টি আসন সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আনুপাতিক হারে বন্টনের ব্যবস্থা করা হয়। ওই সময়ে মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় দুই সংসদের জন্য। মেয়াদকাল নির্ধারন করা হয়েছিলো নবম সংসদ ও দশম সংসদ পর্যন্ত। নবম সংসদের প্রথম বৈঠক থেকে তা কার্যকর করা হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম অধিবেশন হয়েছিল ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি। ওই সময়ের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্যের মেয়াদ থাকবে।
সরকার চাইলে এই সংসদেই নারী সংসদ সদস্যদের মেয়াদ বাড়াতে পারে। আর না চাইলে আগামী সংসদ গঠন করেও প্রথম সংসদে করতে পারে। তবে এখন দুই তৃতীয়াংশ সদস্য রয়েছে সরকারি দলের। তখন না থাকলে সমস্যা তৈরি হতে পারে। তাছাড়া ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নারী সদস্যদের সংখ্যা ৪৫ থেকে ৫০ করা হয়। নতুন করে সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে কিনা সেই বিষয়টিও দেখতে হবে। ২০০৪ সালে ৩০ থেকে ৪৫ করা হয়। ২০১১ সালে ৪৫ থেকে ৫০ করা হয়। এখনও ৫০ই রয়েছে।
যদিও নারী নেত্রীরা মনে করেন, সংবিধানে সংরক্ষিত আসন থাকবে। তবে সেই সব আসনে সরাসরি নির্বাচন হতে হবে। সেখানে নারীদের সঙ্গে নারীদের প্রতিযোগিতা হবে। এখন সংসদে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন কত জন সেই হিসাবে নারী আসন বন্টন করা হয়। সেটা না করে বরং ওই আসনেও সরাসরি ভোট গ্রহণ করা প্রয়োজন। এতে করে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে। আর এখন ৫০টি আসন রয়েছে। এই সংখ্যা বাড়িয়ে কমপক্ষে এক’শ করা প্রয়োজন। সেটা করে বিভিন্ন দল নির্বাচনের সময়ে অন্যান্য সাধারণ আসনে যেভাবে ভোট হয় সেই রকমভাবে নারী সংরক্ষিত আসনেও ভোট হবে। প্রার্থী হবেন কেবল নারীরা। এটা করা প্রয়োজন এই জন্য যে ওই সব সংসদ সদস্যরা সরাসরি কোন দলের প্রতি দায়বদ্ধ না থেকে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবেন। সম্পাদনা : শিমুল মাহমুদ