ডলার সংকটে বাজার অস্থিতিশীল নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ
হাসান আরিফ : রমজানের কারণে ভোগ্যপণ্য আমদানিসহ পণ্য আমদানি বেড়েছে। হজের টাকা জমা দেওয়া চলছে। অপরদিকে প্রবাসী আয়ে গতি কমে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত হিসাবে প্রবাসী আয় কমেছে ১৭ শতাংশ। বিপরীতে আট মাসে রপ্তানি আয় বেড়েছে মাত্র ৩ দশমিক ২২ শতাংশ। এদিকে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেদারছে আসছে বিদেশী ঋণ। সবকিছু মিলিয়ে চাহিদা বাড়ায় ডলারের জাবার অস্থিতিশীল হয়ে পরেছে। এতে আমদানি ব্যয়ও বেড়ে গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বাজার স্থিতিশীল করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ করবে। এরই মধ্যে গত সোমবার রূপালী ব্যাংকের কাছে দেড় কোটি ডলার ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কাছে ৬০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্য ব্যাংকগুলোও ডলার কিনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।
পণ্য আমদানিতে প্রতি ডলারের জন্য চলতি মাসের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা পরিশোধ করেছেন ৮০ টাকা। ২৫ তারিখ আমদানি দায় মেটাতে প্রতি ডলারের দাম ৮৫ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করতে হয়েছে। গতকাল তা ৮২ টাকায় নেমেছে। অস্বাভাবিক দামের ফলে ব্যবসায়ীরা পড়েছেন বিপাকে। আর বড় আমদানি দায় শোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। যদিও গতকাল আন্তঃব্যাংকে এ দর ছিল ৮০ টাকা ০৩ পয়সা।
মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়। আমদানি দায় পরিশোধ করতে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কেনেন গ্রাহকেরা। সাধারণত আন্তঃব্যাংকের সাথে গ্রাহক পর্যায়ে ডলারের দামের পার্থক্য এক টাকার ওপরে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু গ্রাহক পর্যায়ের সাথে আন্তঃব্যাংকের ডলারের দামের পার্থক্য ৫ টাকার কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। যেসব ব্যবসায়ী ঋণপত্র খুলে বিলম্বে দেনা পরিশোধের সুযোগ নিয়েছিলেন, ডলারের দাম বাড়ায় তাঁদেরও খরচ বেড়ে গেছে।
জানা গেছে, অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেদারছে আসছে বিদেশী ঋণ। আগে শুধু রপ্তানিকারকরাই এ ঋণের সুবিধা পেতেন। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নীতিমালা আরো শিথিল করে। এখন রপ্তানিকারকদের বাইরেও সার আমদানি, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পসহ বিভিন্ন পর্যায়ে অফশোর ব্যাংকিংয়ের সুবিধা নিচ্ছে। আমদানিকারকরা যখন বৈদেশিক ঋণ নিয়ে পণ্য আমদানি করছে, তখন ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের মাধ্যমে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করত তা বাজারে উদ্বৃত্ত ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো ইচ্ছামাফিক নিজেদের কাছে বৈদেশিক মুদ্রা ধরে রাখতে পারছে না। এ জন্য নির্ধারিত সীমা বেঁধে দেয়া হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। নীতিমালা অনুযায়ী একটি ব্যাংক দিন শেষে তার মোট মূলধনের ১৫ শতাংশ সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা নিজেদের কাছে সংরক্ষণ করতে পারে। দিনশেষে নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ডলার থাকলে বাজারে বিক্রি করতে হবে। বাজারে বিক্রি করতে না পারলে ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তা বিক্রি করতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে জরিমানা গুনতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের মান ধরে রাখার জন্য গত কয়েক বছরে বাজার থেকে উদ্বৃত্ত ডলার কিনে রিজার্ভের ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু এখন রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। আগে যেখানে প্রতি মাসে দেড়শ’ কোটি ডলার আসত এখন তা ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে গেছে। অন্য দিকে রফতানি আয়ও কমে গেছে। এ দিকে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণ নেওয়া হয় সর্বোচ্চ ছয় মাস মেয়াদে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ৯০০ কোটি ডলারের ঋণ রয়েছে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। এ ঋণও ধারাবাহিকভাবে মেয়াদ শেষে পরিশোধ শুরু হয়েছে। সব মিলে এক দিকে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বেড়ে গেছে। কিন্তু এর বিপরীতে সরবরাহ না বেড়ে বরং কমে গেছে। ফলে বেশির ভাগ ব্যাংকেরই ডলারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে সোয়া ৩ হাজারের উপরে রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিদেশের ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা স্থিতি, বৈদেশিক বন্ড, এসডিআর ইত্যাদি আকারে রক্ষিত থাকে। তবে বৈদেশিক মুদ্রা নোট আকারে সংরক্ষণ করা হয় না। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বৈদেশিক মুদ্রা নোটের স্থিতি নেই। তাই বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক জব্দকৃত বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষুদ্র স্থিতি থাকে। অপরদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা সম্পদের বেশিরভাগই ব্যাংকের কাছে স্থিতি আকারে জমা থাকে। এর খুব সামান্যই নোট আকারে রক্ষিত হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে নগদ ডলার নোটের স্থিতির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোর কাছে রক্ষিত মার্কিন ডলার নোট ও কয়েনের স্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। এই অবস্থায় নোট ও কয়েনের স্থিতি গড়ে ২০১৩ সালে ২৭ মিলিয়ন, ২০১৪ সালে ২৮ মিলিয়ন ডলার, ২০১৫ সালে ২১ মিলিয়ন ডলার, ২০১৬ সালে ১৩ মিলিয়ন ডলার এবং ২০১৭ সালের জানুয়ারি শেষে মাত্র ৮ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। যা গত ৪ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা এই প্রতিবেদককে বলেন, বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব উদ্যোগ নিয়েছে। এরমধ্যে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়েছে। বাকি সমস্যাও যাতে সমাধান হয় এবং এধরনের পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়ে সব ব্যাংক নির্বাহীদের নিয়ে রোববার এক বৈঠকে বসা হবে। সেখানে এসব বিষয় পর্যালোচনা করা হবে। সম্পাদনা : শিমুল মাহমুদ