অবমানে অপমানে মুহ্যমান আলীর আত্মহনন
অরুণ কুমার বিশ্বাস
মারা গেলেন লোকটা। বড় কষ্ট বড় অসহায়ত্ব নিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন গাজীপুরের হযরত আলী। শুধু নিজে নন, আদরের মেয়েটাকেও এই পথ দেখালেন তিনি। হযরত আলী সমাজের উচ্চবিত্ত বা কেউকেটা কেউ নন। তিনি সমাজের একজন সাধারণ মানুষ, অতি প্রান্তজন। এটাই বোধ করি অপরাধ ছিল হযরত আলীর।
এমন নয় যে, সামান্য কষ্টে রেললাইনে মাথা দিয়েছেন তিনি। তার মতো একজন প্রান্তিক মানুষ আবেগতাড়িত হয়ে টুপ করে মরে গেলেন, এমন ধারণাও সঠিক নয়। সমাজের কাছে তার কিছু দাবি ছিল, ছিল কিছু প্রত্যাশা। আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া নয়, দামি পোশাক বা নিত্য দুবেলা পোলাও-কোর্মা খাবার মতো বিলাসী স্বপ্নও নয়। আলী চেয়েছিলেন একটু সম্মানের সঙ্গে মেয়েটাকে নিয়ে বাঁচতে। কিন্তু আমাদের সুসভ্য সমাজ তাকে সে সুযোগ দেয়নি। তিনি একরকম বাধ্য হয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন। সমাজের গালে সপাটে চড় কষিয়ে চির বিদায় নেন দুনিয়া থেকে।
মেয়েটা বড় আদরের ছিল হযরত আলীর। হোক না পালিতা মেয়ে, তাকে পেয়ে আলী দুহাত তুলে স্রষ্টার কাছে শুকরিয়া আদায় করেছিলেন। এমন চাঁদের মতো মেয়ে তাকে জুটিয়ে দিয়েছেন, এজন্য স্রষ্টার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানান। এমন সৌভাগ্য কজনার হয়! মেয়ে বড় হয়, হযরত আলী মেয়ের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন, খুশিতে তার দুচোখের কোল বেয়ে নামে অফুরান আনন্দধারা। মেয়ে তো নয়, সে যে আলীর মায়ের মতো। মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অব্যক্ত সুখ পান আমাদের অতি সাধারণ মানুষ হযরত আলী।
মেয়েটা ক্রমশ ডাগর হয়ে ওঠে। কেমন সুন্দর ঢলঢলে মায়াবী চাঁদপানা মুখ! আলী খুশি হন, আবার তার বুকের ভেতর দানা বাঁধে অন্যরকম কষ্ট-ভয়! কিসের ভয় তার! সে তো সমাজের কেষ্টবিষ্টু কেউ নন। তার মেলা টাকাও নেই যে কেউ ছিনিয়ে নেবে। ব্রাত্যজনের কি বাটপাড়ের ভয় থাকে! মিছে কী নিয়ে ভাবছে তাহলে হযরত আলী! ভয় তার ফুটফুটে মেয়েটাকে নিয়ে। মেয়ে যত বড় হয়, আলী টের পান, তত তার গেরস্থ ঘিরে বেড়ে যায় শ্বাপদের আনাগোনা। থেকে থেকে শোনা যায় শেয়ালের হাঁক। কিসের যেন বদগন্ধ পান হযরত আলী। মেয়েটা কি তবে নিরাপদ নয় আর! কারা ওরা, কী চায়! কাদের ছত্রছায়ে এমন নির্লজ্জ উল্লম্ফন ওদের?
মেয়ের মা তাকে সতর্ক করে বলেন, কিছু সন্ত্রাসী নিত্য মেয়ের পিছু নেয়। ইনিয়ে-বিনিয়ে কুপ্রস্তাব দেয়। তুমি কিছু করো। সাদা মনে কাদা নেই হযরত আলীর। ভেবেছিলেন এই সভ্যসমাজে তার আদুরে মেয়েটাকে বাঁচানোর মতো কেউ হয়তো আছে। তিনি ছুটে যান আইন রক্ষাকারীর কাছে। অনুনয়-বিনয় করে বললেন, মেয়েটাকে বাঁচান, হুজুর! ওরা আমার মেয়েকে বাঁচতে দেবে না। মশা-মাছি তাড়ালেন, যাদের কিনা আলীর মেয়েকে নিরাপত্তা দেবার কথা। কিংবা কে জানে, আলী হয়তো সংবিধানের ভাষায়, এ দেশের নাগরিকই নন। তাহলে আইনের চোখে তার সমতা ও সুরক্ষাটুকু অন্তত নিশ্চিত হওয়ার কথা। সে অতি নিরীহ ব্রাত্যজন, তার আবার অধিকার কিসের! কে শোনে তার কথা! এ সমাজ আলীদের নয়, বাবুসায়েবদের। এখানে কর্তাব্যক্তিরা ব্যস্ত ভীষণ- আমজনতার ফরিয়াদ শোনার সময় কোথায়!
ফলে শ্বাপদের লালসা ক্রমশ গ্রাস করে নেয় আলীর মেয়েটাকে। কানে তুলোগোঁজা বয়রা সমাজ তার করুণ আর্তনাদ শোনে না। সহসাই বড্ড শীত শীত ঠেকে হযরত আলীর। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেনÑ আর নয়, অনেক বেঁচেছি মা। চল এবার তোকে বাঁচাই। এ সমাজ যখন দেখবে না, দেখি পরপারে গিয়ে মাকে আমার বাঁচানো যায় কি না! এক দুর্বোধ্য অভিমান ও অসহায়ত্ব নিয়ে আত্মঘাতী হলেন আমাদের হযরত আলী।
দোষ কার! কারও না, ওই বোকা লোকটার। যে কিনা আপোসরফা করতে জানে না। মেয়ের সম্ভ্রম নিয়ে অমনি উদ্বিগ্ন হয়! এই সমাজে ওসব ঠুনকো মান-সম্মানের মূল্য কোথায়! বেঁচে থাকাটাই এখানে শেষকথা হযরত আলী! তুমি নির্বোধ, তাই বুঝলে না। মেয়েকে বাঁচাতে শেষে রেললাইনে মাথা দিলে! বিচার চাও, কে করবে বিচার! তুমি কে হে আলী! তোমার পরিচয় কী। মামুলি কৃষক বৈ তো নও। আমরা প-িত তাই বেঁচে আছি। চরম নির্লজ্জের মতো বেঁচে আছি। খেয়েপরে গা-েপি-ে গিলে। সম্ভ্রম নিয়ে ভাবছে কে! হযরত আলী মরে বাঁচলেন। মোদের দুকান কাটা তাই, লাজ-শরমের বালাই নাই।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
সম্পাদনা: আশিক রহমান