আমি ৫৭ ধারার পক্ষে, আপনি?
প্রত্যেকটা টপিকেরই একটা লাইফ টাইম থাকে। টপিক হিসেবে কাশেম বিন আবু বাকার সম্ভবত তাঁর লাইফ টাইমের শেষ দিকে। তাঁকে ফেসবুকজুড়ে শুরু হওয়া আবোল তাবোল লেখালেখি এখন প্রায় শেষের পথে। তাঁর সাহিত্য নিয়ে আলোচনা এখন শেষ, শুরু হয়েছে তাঁর বাল্যপ্রেম নিয়ে। সম্প্রতি এক ইন্টারভিউতে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী রহিমার প্রেমে পড়ার তথ্যটা দেওয়ায় প্রায় শেষ হয়ে আসা আলোচনা কিছুটা দীর্ঘায়িত হয়ে যায়। বাল্যবিবাহ, বাল্যপ্রেম, শিশুদের প্রতি কাম দৃষ্টি ইত্যাদি ইত্যাদি আলোচনা নিয়ে ফেসবুক এখন আবার গরম। পক্ষে-বিপক্ষে লেখালেখি চলছে। শেখ মুজিবুর রহমান থেকে রবীন্দ্রনাথ, সব্বাইকেই মাঠে নামানো হয়ে গেছে। ওদিকে ‘আফসাইন্যা’ (আফসান চৌধুরী) কাশেম সাহেবকে ‘কাশেইম্যা’ বলে কাজটা ঠিক করেছেন কি না, তা নিয়ে অনেকে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। ব্যাপারটায় কিছুটা রেসিজমের পরিচয় হয়তো দিয়েছেন, তো কী হয়েছে? উনি অনেস্টি দেখিয়েছেন। একজন রেসিস্ট, রেসিস্টের মতো আচরণ করেছেন, এ নিয়ে প্যাঁচাল পারার কী আছে। একসেপ্ট ইট ম্যান।
যাই হোক, এনাফ ইজ এনাফ। চলুন আমরা নতুন টপিকের সন্ধানে নেমে পড়ি। আপাতত খবর হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী হাওরে গিয়েছেন। কেবলই সমবেদনা জানাবার জন্য যাননি, আই থিংক। হাওরের টাকা মেরে খাওয়ায় তাঁর সরকারের ওপর যে পরিমাণ কালিমা লেপন হয়েছে, তিনি তার একটা বিহিত করতে গিয়েছেন। কাজ শুরু হয়ে গেছে। তিনজন ধরা খাওয়া চুনোপুঁটির চাকরি নট হয়েছে। অ্যান্ড আই থিংক দ্যাটস ইট। ‘ছাগল মরেনি’র কিছু হবে না কিংবা সেই কন্ট্রাক্টারেরও টিকির দেখা পাওয়া যাবে না। সো, যারা এই চাকরি নটের খবরে আলোর ঝিলিক দেখছেন, তাঁরা চশমাটা খুলে একটু পরিষ্কার করে নিন। আগামী বছর হাওরের বাঁধ নির্মাণে আশা করা যায় বরাদ্দ বেশি হবে কিংবা মারিং কাটিং একটু কম হবে। তবে পরের বছর, ব্যাক টু স্কয়ার ওয়ান।
ওদিকে, ম্যাডাম খালেদা জিয়া হাওরে যাননি। কেন? ঠিক ক্লিয়ার না। অসুস্থ? না ইচ্ছা নেই? নাকি এতোসব ঘটনার পরে, ঐ ভোট তো আর এমনিতেই আওয়ামী পাতে যাবে না, সো না গেলেও ভোট পাচ্ছি। আই থিংক, হাওর সেই অর্থে পাবলিসিটি পাচ্ছে না। সো উনি গেলেও বড় কোনো নিউজ হতো না, মাঝখান থেকে অতো দূর যাওয়ার একটা ধকল সহ্য করতে হতো। ইন আ নাট শেল, ওখানে যাওয়া খুব লাভজনক না।
এছাড়া, যেয়ে করবেনই বা কি, কাজ তো ঐ একই। সরকারকে গালি দেওয়া, এই তো? ওটা ঢাকা থেকেই দেওয়া যায়। একটা সংবাদ সম্মেলন ডাকলে বরং সাংবাদিকরা খুশি। ওদেরও তেমন সখ নাই হাওরে যাওয়ার। আসলে, ক্ষতিগ্রস্ত জনতা কখনই ইস্যু ছিল না, ভবিষ্যতেও হবে না। বরং এই ভালো। এই দূরে থাকায় একটা সততা আছে, ‘ভাই তোদের দুঃখ-কষ্টে আমার কিছু যায় আসে না। শুধু ভোট ছাড়া আমার আর কিছু দরকার নাই’।
হাওর শিরোনাম থেকে সরে যাওয়ার পরে আরও দুটো খবর শিরোনাম হ্যাঁ-এর দৌড়ে ছিল। ঠিক পুরোপুরি না হলেও আংশিকভাবে এখন তা ফেসবুক মাতাচ্ছে। প্রথমটি হচ্ছে পিতা-কন্যার আত্মহত্যা আর দ্বিতীয়টি আইসিটি ৫৭ ধারা। আত্মহত্যা নিয়ে আমি বেশ হতাশ। ব্যাপারটা যতটা বাজার পাওয়ার কথা ছিল, ততোটা পায়নি। কেন পায়নি, তা নিয়ে অবশ্য কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আছে। বলা হচ্ছে সরকারের ইশারায় এই খবরকে হাই প্রোফাইল করা হচ্ছে না। ব্যাপারটায় কিছুটা সত্যতা থাকতে পারে। স্পেশালি, সরকার এমনটা চাইলে, মিডিয়া স্বেচ্ছায় ব্যাপারটায় সমর্থন দিবে। তবে এক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে, কাহিনী অন্য। এই মুহূর্তে এই পিতা আর কন্যার আত্মহত্যার চেয়ে কাশেম সাহেব অনেক বেশি সেক্সি নিউজ। বিশেষ করে রহিমা রেভেলিশানের পরে, খবরটায় নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। আত্মহত্যাটা আর দিন পাঁচেক পরে করলে, বোধহয় ভালো মার্কেট পেত। এনিওয়ে, দেখা যাক, কি হয়।
দ্বিতীয় খবর ৫৭ ধারা। জনৈক সাংবাদিক ধরা খেয়েছেন। যথারীতি এ নিয়ে অনেকে বেশ উৎসাহী। নিজেদের জাতভাই যেহেতু ধরা খেয়েছে, তাই তাঁর পক্ষে কলম ধরা ফরজ। প্রায় সব সাংবাদিকেরই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে, অন্তত নতুন প্রজন্মের গুলোরতো আছেই। তাঁদের মধ্যে যারা আওয়ামী, তাঁরা কিছুটা দ্বিধায় আছেন। চিল্লাচিল্লি করবেন? না সাংবাদিকদের আত্মসমালোচনার দিকে আলোচনাকে ঘোরাবেন, তা নিয়ে গড়িমসি করছেন। বামগ্রুপ অবশ্য যথারীতি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছেন। নীতিকথা পার্টিও যথারীতি ‘বাকস্বাধীনতা’ লাইনে আলাপ চালাচ্ছেন। কেউ কেউ দেখলাম অন্য পক্ষের গান গাইছেন। মিউ মিউ করে বলার চেষ্টা করছে, রাজু সাহেবের রিপোর্টটা পড়ে কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতই মনে হয়েছে। অমনি ধমক আসছে। ‘এই মুহূর্তে ইউনিটিতে ফাটল ধরে এমন কিছু বলা হারাম’। মোদ্দা কথা, রাজুর দোষ থাকলেও এখন তা স্বীকার করা যাবে না। আগে গ্রেফতার উইথড্র, তারপরে অন্য আলাপ।
তাহলে কি দাঁড়াল? সিম্পল, ঠিকই তো চলছে। কোনো ডিজাস্টারের পরে কিছু চুনোপুঁটির ঘাড় মটকানো, গরিবের বিচার না পাওয়া, শক্তিশালীর ক্ষমতার দাপট দেখানো। এখানে নতুন নিউজ কি? বরং দেশ তার নিয়মেই চলছে। আমাদের কাজ হচ্ছে এসব থেকে কোনো খবরকে সেক্সি বানানো যায়, তা খুঁজে বের করা। তা করছি। খবর বাছাই করার কাজ নিয়ম মেনেই চলছে। মুখরোচক খবরগুলো শিরোনাম হচ্ছে। কাশেম সাহেবের প্রেম নিউজ হিসেবে যে ট্রিটমেন্ট পাচ্ছে, পিতা-কন্যার আত্মহত্যা তা পাওয়ার কথা না। এক দরিদ্র পিতা বিচার চেয়ে পাননি, এটা কোনো খবর? কেবল আত্মহত্যাটা খবর। তবে এই ঘটনা গুলশান কিংবা বনানীতে হলে কিংবা কোনো ধনকুবের জড়িত থাকলে? তখন এটা খবর হতো, বরং বলা উচিত ব্লক ব্লাস্টার হিট হতো। সাকিব-অপু মনে আছে?
এই দায়সারা গোছের মানসিকতার একটা কারণও আছে। যা প্রতিদিন দেখছি কিংবা যা স্বাভাবিক, তা নিয়ে জানতে চাওয়ার ইচ্ছা আমাদের কারও নাই। প্রধান বিচারপতি যে বললেন, দেশে আইনের শাসন নেই, এখানে তাঁর বক্তব্য কিন্তু খবর না, তাঁর স্বীকারোক্তি খবর। তো এই জানা তথ্যগুলো এখন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের মুখ থেকে আসছে, এই যা। এর আগে কি আমরা জানতাম না? জানতাম। ধর্ষণের বিচার না পাওয়াতে কি সত্যিই কেউ আশ্চর্য হয়েছেন? আমি হইনি। আত্মহত্যাতে? কিছুটা। তবে প্রথম এমন ঘটনা ঘটল বলে। আই থিংক এর পরের জনের জন্য এই অবাক হওয়াটাও থাকবে না। অ্যান্ড তিনি এই প্রচারণাও পাবেন না।
যা বলতে চাইছি, তা হচ্ছে, আমরা একটা বাস্তবতার মাঝে বাস করছি। আইন আছে, তবে সবার জন্য না। যাদের জন্য আইন না, তাঁরা নতুন এক ফর্মুলা দাঁড় করিয়েছে। মেনে নাও। আর কিছু গবেট আছে, যারা এখনো বিচার চায়। সেই উজবুকদের জন্য আছে হাজার টাকার সালিশ আর নয়তো ‘ট্রেন থেরাপি’।
তাহলে সারাংশ কী দাঁড়াল? সারাংশ হচ্ছে গরিব হয়েছেন, গরিবের মতো থাকেন। আপনার উপর কোনো অত্যাচার হলে মুখ বুজে সহ্য করবেন। বিচার চাইবেন না কিংবা কারও কাছে ধরনাও দিবেন না। স্পেশালি অপরাধী যদি শক্তিশালী কেউ হয়। এভাবে রেপড হয়ে চলতে পারলে চলবেন, আর মরতে চাইলে মরবেন। উই ডোন্ট কেয়ার। দু-একদিন নিউজ করে দিব। তেমন হিট নিউজ না থাকলে দু-চারদিন পাবলিসিটিও পাবেন, তবে ঐ পর্যন্তই। এর বেশি আশা কইরেন না। হ্যাঁ, পকেটে টাকা থাকলে কাহিনী অন্য। তখন আইনের কাছে আইসেন, আর নয়তো রাস্তা মাপেন। বরং আপনারে যে জিন্দা রাখছি, তাঁর জন্য হাজার শোকর করেন।
এ কারণেই আমি ৫৭ ধারার পক্ষে। ৫৭ ধারা আসলে কি? কিছু ক্ষমতাবানকে ঘাঁটানো যাবে না, এই তো? এতে নতুন কি? আগে ব্যাপারটা অলিখিত ছিল, এখন লিখিত, এই যা। এদেশে থাকবেন, আর এদেশের প্রভাবশালী, কর্পোরেটের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে, কিছু স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, তা হবে না। এই আইনটা না থাকলে কি হতো? সেই পিতার মতো বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরতেন আর তারপরে ট্রেন থেরাপি নিতেন। তারচেয়ে তো এই-ই ভালো। আপনি আগে থেকেই জানছেন, এই রুই-কাতলাকে ঘাঁটালে কী হবে। বরং এই আইনকে স্বাগত জানান। এমন আরও আইন বাজারে আনতে মানববন্ধন করুন।