বিবিসি বাংলার পর্যালোচনায় হেফাজতের সমাবেশ
তারিক ইমন : আজ থেকে চার বছর আগে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরের এক বিশাল সমাবেশের মধ্যদিয়ে আলোচিত হয়ে উঠে ইসলামপন্থি সংগঠন হেফাজতে ইসলামী। কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে ইসলামকে কটূক্তি করার অভিযোগ তুলে তাদের শাস্তির দাবিসহ মোট ১৩ দফা দাবি তুলে হেফাজতে ইসলাম তখন মাঠে নেমেছিল। সে সময় দেশে ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রথমেই জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার রায় হয়েছিল ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। যুদ্ধাপরাধের দায়ে তার যাবজ্জীবন সাজা হওয়ায় তার বিরুদ্ধে একদল তরুণ সেদিন ঢাকার শাহবাগে আন্দোলনের সূচনা করেছিল। ওই আন্দোলনের শুরু করেছিল ব্লগারদের একটা অংশ যাদের বিরুদ্ধে ইসলাম ও হযরত মুহম্মদ সা. কটূক্তি করার অভিযোগ উঠেছিল। সেই পটভূমিতেই ব্লগারদের শাস্তির দাবিকে সামনে এনে হেফাজতে ইসলাম মে মাসে মাঠে নেমেছিল। ৫ মে সেদিন সমাবেশকে ঘিরে ঢাকায় দিনভর সহিংসতা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে এবং পরে মধ্যরাতে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের মাধ্যমে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়।
সমাবেশের দিনে ঢাকা শহরের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিবিসি বাংলার ঢাকার সংবাদদাতা কাদির কল্লোল বলেন, সেদিন আমরা সার্বক্ষণিক সেখানে অবস্থান করেছিলাম, সেদিন ৫ মে ঢাকার পল্টন, বিজয়নগর, গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছিল, ভোর পাঁচটার দিকে ফজরের নামাজের পরেই হেফাজতের নেতাকর্মীরা সারা দেশ থেকে কওমি মাদ্রাসা থেকে আসা হাজার হাজার শিক্ষক ছাত্র ঢাকার প্রবেশ পথগুলোতে অবস্থান নিয়েছিলেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে হেফাজতের নেতৃত্ব যখন ঢাকায় প্রবেশ করে মতিঝিলের শাপলা চত্ব¡রে যাওয়ার ঘোষণা দেয়, তখন প্রবেশ পথগুলোতে অবস্থান নেয়াদের সকলের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। হেফাজতের নেতৃত্ব শাপলা চত্ব¡রে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ার পর সেখানে অনুমতি নেয়ার জন্যে পুলিশের সাথে আলোচনা চলছিল কিন্তু অনুমতি পাওয়ার আগেই বেলা ১১টার দিকে তাদের কয়েকটি মিছিল নগরীতে ঢুকে পড়লে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে শুরু করে পল্টন পর্যন্ত গোটা এলাকায় সংঘর্ষ শুরু হয়। দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকার প্রবেশ পথগুলো থেকে হেফাজতের নেতা কর্মীরা এসে শাপলা চত্ব¡রে অবস্থান নেয়।
সেদিন তারা কেন সমাবেশ শেষ না করে সেখানে অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, হেফাজতের নেতারা অনেকেই বিভিন্ন সময় বলেছিলেন অনেকটা আকস্মিকভাবেই অবরোধ কর্মসূচি থেকে ঢাকায় প্রবেশ করা এবং শাপলা চত্ব¡রে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে সংগঠনটির একাধিক নেতা আমাকে বলেছিলেন জমায়েত দেখে তাদের মনে হয়েছিল তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে একটা বড় ধরনের চাপে ফেলতে পারবে। এছাড়া সরকারবিরোধী জোট থেকে তাদের প্রতি এক ধরনের সমর্থন দেয়া হচ্ছিল। ফলে আওয়ামী লীগ সরকার অনেকটা নরবরে বা দুর্বল অবস্থায় পড়েছে এমন একটা ধারণা হেফাজতের নেতৃত্বের একটা অংশের মধ্যে তৈরি হয়েছিল। সেই অংশের চাপের কারণে রাতে শাপলা চত্ব¡রে তারা অবস্থান নিয়েছিলেন। তবে হেফাজতের মূল নেতৃত্বের বক্তব্য হচ্ছে, মাদ্রাসা থেকে আসা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রাতে ঢাকার বাইরে যেতে পারবে না সে কারণে সেদিন রাতে তারা সেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন।
সরকার কেন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে দিতে এমন প্রশ্নের জবাবে কাদির কল্লোল বলেন, সরকার মনে করেছিল যে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সাথে যোগাযোগের ভিত্তিতেই হেফাজতে ইসলাম সেদিন সেখানে অবস্থান নেয়। রাত পার হলেই এই সমাবেশকে রাজনৈতিক দিকে নিয়ে যাওয়া হতে পারে সে কারণেই সরকার শাপলা চত্ব¡র থেকে তাদেরকে উঠানোর একটা পরিকল্পনা করছিল। এবং সেটা বাস্তবায়নের পথ সরকার খুঁজছিল শেষ পর্যন্ত ভোর রাতে যখন জমায়েত কমে যায় ঠিক তখন আইনশৃঙ্খলা বহিনী অভিযান চালিয়েছিল। রাত পৌনে তিনটার দিকে পূর্ণাঙ্গভাবে অভিযান শুরু করে, একদিক খোলা রাখা হয়েছিল এবং তিন দিক থেকে শত শত রাউন্ড গুলি, সাউন্ড গ্রেনেট, কাঁদানি গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এগুলোর শব্দে এবং আলোর ঝলকানিতে সেদিন সেখানে একটা ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, ফলে মাত্র ১০ মিনিটেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শাপলা চত্ব¡রে পৌঁছে গিয়েছিল।
সেই অভিযানের পর মৃতের সংখ্যা বিতর্ক নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন শাপলা চত্ব¡র দখলে নিয়েছিল তখন ট্রাকের উপরে নির্মিত ভ্রাম্যমাণ মঞ্চের পাশেই একটি ভ্যানে কাফনের কাপড় ও পলিথিনে মোড়ানো চারটি মৃতদেহ ছিল, আমরা সাংবাদিকরাও সে মৃতদেহগুলো দেখেছি, এগুলো দিনের সংঘর্ষে নিহত হয়েছিল বলে পুলিশ দাবি করেছিল। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই অনেক মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল ইন্টারনেটে এবং মানুষের মুখে মুখে রাতে আসলে সেটা দেখা যায়নি। হেফাজতের দিক থেকেও শত শত মৃত্যুর দাবি করা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হেফাজত সেই অবস্থানে আর থাকেনি, তবে রাজনৈতিক একটা কারণ ছিল এ ধরনের বিতর্কের পেছনে বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন। সম্পাদনা : জাহিদ হাসান