অনিয়মের বেড়াজালে বিআরটিসি হুমকির মুখে ভবিষ্যৎ
আরিফুর রহমান তুহিন : কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, পরিবহন সংকট, দুর্নীতি, অনিয়ম আর নানা প্রতিবন্ধকতায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় পরিবহন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কতৃপক্ষ-বিআরটিসি। মাত্র ১৫৩৮টি গাড়ি নিয়ে গঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য বিশাল পরিচালনা পর্ষদ থাকলেও ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে বিলুপ্তির পথে। এরই মধ্যে প্রায় অর্ধেক গাড়ি ব্যবহারের অনুপযুক্ত। ৫৯৮টি গাড়ি বিকল হয়ে পড়েছে আছে বিভিন্ন ডিপো বা ওয়ার্কশপে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল প্রতিষ্ঠানটিকে সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার পরেও দেখাতে পারছে না কোনো লাভজনক অগ্রগতি। যেখানে বেসরকারি পরিবহন কোম্পানিগুলো লাভজনক অবস্থায় থেকে তাদের ব্যবসা আরও বৃদ্ধি করছে সেখানে বিআরটিসি এগিয়ে যাচ্ছে দেউলিয়ার পথে। আর এর দায় নিতে চাচ্ছেন না কেউ। দোষারোপ করছেন একে অপরকে। সূত্র জানায়, ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি সবসময় সরকারের উপর নির্ভরশীল হয়ে আসছে। লোকসানে থাকা বিআরটিসির ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকে শুরু করে ১ম শ্রেণির কর্মকর্তা সকলেই হতাশ এর ভবিষ্যৎ নিয়ে। নিয়মিত বেতন না দেওয়া, অতিরিক্ত কাজ করানো, অতিরিক্ত কাজের পারিশ্রমিক না দেওয়ার মতো শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সকলের। রয়েছে পর্যাপ্ত চালক সংকট। আর দুর্নীতির অভিযোগ সাধারণ নাগরিক থেকে বিআরটিসির কিছু নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা সকলের মাঝে।
প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের প্রায় প্রতি মাসে ঠিক সময়ে বেতন দিতে পারে না কতৃপক্ষ। অনেক সময় এক মাসের বেতন আরেক মাসে প্রদান করা হয়। অজুহাত হিসেবে কর্তৃপক্ষ বিআরটিসির অলাভজনক অবস্থাকে দেখায় বলে জানান ভুক্তভোগীরা। বিআরটিসির কয়েকজন বাসচালক জানায়, নিয়োগের সময় তাদের বলা হয়েছিল একদিন গাড়ি চালালে পরের দিন বিশ্রাম দেওয়া হবে। অথচ তাদেরকে দিয়ে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গাড়ি চালানো হয়। প্রতিদিন বিশ্রামহীন এমন কঠোর পরিশ্রমের কারনে তারা শারীরিক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ করেন।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে বিআরটিসির কর্তাদের মাঝে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য পাওয়া যায়।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বিআরটিসির কাউকেই অতিরিক্ত কাজ করানো হয় না। তাদের চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম দেওয়া হয়। কারও কোনো অভিযোগ থাকলে সরাসরি তার কাছে অভিযোগ করার জন্য বলেন তিনি। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এম রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, বিআরটিসির পর্যাপ্ত চালক না থাকায় শুধুমাত্র স্টাফ বাসের চালকদের দিয়ে প্রতিদিন গাড়ি চালাতে হয়। কারণ তাদের ডিউটি অন্যদের তুলনায় কম। (যদিও চালকদের দাবি স্টাফ বাসগুলো স্টাফদের নির্দিষ্ট স্থানে নামিয়ে দিয়ে বাকি সময়ে তারা বিভিন্ন রুটে টিপ মারে)। তবে অন্য চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের ব্যবস্থা আছে। এর বিনিময় বাড়তি কোনো অর্থ দেওয়া হয় না বলে স্বীকার করেন তিনি। চালক সংকটের কারণ জানতে চাইলে রফিকুল জানান, বিআরটিসি ৩ বার চালক চেয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত যোগ্য চালক পাওয়া যায়নি। যাদের পেয়েছে তাদের হয় বিজ্ঞপ্তির শর্ত অনুযায়ী ৭ বছরের যোগ্যতা ছিল না, না হয় ৮০% ভুয়া ড্রাইভিং সনদ নিয়ে এসেছিল। তাই কোঠা অনুযায়ী চালক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। আবারো চালকের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে এবং এতে অভিজ্ঞতার যোগ্যতা কমানো যায় কিনা তাও ভেবে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বিআরটিসির এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানায়, সরকার বিআরটিসিকে একটি ঐচ্ছিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখে। বিআরটিসির বাৎসরিক বাজেট ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জ্বালানি বাবদ খরচ হয় প্রায় ১০০ কোটি আর বেতন বাবদ দেওয়া হয় প্রায় ৮৫ কোটি টাকা। বাকি থাকে ১৫ কোটি টাকা অথচ গাড়িগুলো মেরামতের জন্য এর চেয়ে বেশি খরচ হয়। আমরা যখন অবসরে যাই তখন সামান্য কিছু টাকা দেওয়া হয়। তাও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। ফলে সঙ্গে জড়িয়ে পরে। তিনি রসিকতা করে বলেন, শুকনা খালে ক্ষুধার্ত বক কিইবা খেতে পায়।
বিআরটিসির বহরে থাকা বর্তমানের গাড়িগুলোর মান সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা জানায়, বিআরটিসি ১০-১৫ বছর আগে যে গাড়িগুলো কিনেছিল সেগুলো এখনো অনেকটা ভালো অবস্থায় আছে। তবে ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে যে গাড়িগুলো যুক্ত হয়েছিল সেগুলোর অবস্থা শুরু থেকেই খুব খারাপ। এগুলো রানিং কম। খুব দ্রুত নষ্ট হওয়ায় মেরামত খরচও খুব। এমন খারাপ গাড়ি কেনো কেনা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি জানান, সরকারকে ঋণ করে বিদেশিদের টাকায় গাড়ি কিনছে। ঋণদাতাদের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী তাদের প্রস্তাবিত কোম্পানির গাড়ি কিনতে হয়। তাই ইচ্ছা করলেও আমাদের পছন্দ অনুযায়ী গাড়ি কেনা সম্ভব হচ্ছে না।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, সরকার সাত বছরে মোট ৯৫৮টি বাস ক্রয় করেছে। যার সম্ভাব্য বয়স ধরা হয়েছিল ১৫ বছর। অথচ ২৭৩টি এরই মধ্যে বিকল হয়ে গেছে। অন্যদিকে ১৫ বছর আগে কেনা অন্য গাড়িগুলো এখনো এর থেকে ভালো চলছে। তিনি বলেন, সরকার যাদি ভালো মানের ৪২ সিটের ও জাপানি মডেলের কিছু ডাবল ট্রেকার কিনে এবং পর্যাপÍ মনিটরিং করা যায় তবে আবারো বিআরটিসি লাভজনক অবস্থানে নেয়া সম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘদিন যাবত বিআরটিসির অনিয়ম নিয়ে কথা উঠলেও সরকার কিংবা দুদক কখনোই এর সত্যতা নিয়ে তদন্ত করেনি। দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় পরিবহন প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে এর সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে সমাধান করত প্রতিষ্ঠানটিতে যদি কোনো দুর্নীতি বা অনিয়ম থাকে তবে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা গেলে এবং পর্যাপ্ত জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে পারলে প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক অবস্থানে দাঁড়াবে। সেইসঙ্গে ঢাকা শহরের পরিবহন সংকট দূর করতে উৎকৃষ্টমানের গাড়ি নামাতে হবে। সম্পাদনা : মুরাদ হাসান