এসএসসির ফলাফলে ওঠানামা ও ভিন্নতা, মানে আস্থাহীনতা
গত বৃহস্পতিবার ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীন অনুষ্ঠিত এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। মোট ১৭ লাখ ৮১ হাজার ৯৬২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ১৪ লাখ ৩১ হাজার ৭২২ জন। পাসের হার ৮০.৩৫ শতাংশ, এতে জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৬১ জনÑ যা গত বছরের চেয়ে ৫ হাজার কম। ১০ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সবচাইতে কম পাসের হার কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে ঘটেছে। পাসের হার ৫৯.০৩ শতাংশ। গতবার এই বোর্ডে পাসের হার ছিল ৮৪ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় এ বছর এই বোর্ডে পাসের হার কমেছে ২৫ শতাংশ। সবচাইতে বেশি পাস করেছে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে-৯০.৭০ শতাংশ। মাদ্রাসা বোর্ডের দাখিল পাসের হার ৭৬.২০ শতাংশ, গেল বছর তা ছিল ৮৮.২২ শতাংশ, কমেছে ১২ শতাংশের বেশি। গেল বছর জিপিএ ৫ পয়েছিল ৫৯৯৫ জন, এ বছর তা ২৬১০ জন। শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এ বছর ২,২২৬টি, গত বছর তা ছিল ৪,৭৩০টি। কেউ পাস করেনি এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এ বছর ৯৩টি যা গত বছর ছিল ৫৩টি। এ বছর পরীক্ষায় মোট অংশগ্রহণ নেওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হচ্ছে ২৮,৩৫৯টি। পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে অন্যান্য বছরের ন্যায় এ বছরও পত্রপত্রিকায় কিছু মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেউ লিখেছেন পাসের হার কমেছে, নতুন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন হওয়ায় এমনটি ঘটেছে ইত্যাদি।
প্রতি বছরই এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর একদিকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আনন্দ ও মিষ্টি বিতরণের উৎসব লক্ষ্য করা যায়, অন্যদিকে অনুত্তীর্ণ বা প্রত্যাশিত ফলাফল লাভে ব্যর্থ বা বঞ্চিতদের মধ্যে হতাশা বয়ে যাচ্ছে। তবে বরাবরই গ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশার দৃশ্যটি বেশি পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। উত্তীর্ণ, অনুত্তীর্ণ এবং ভালো-খারাপ করার ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকার চিত্র গোটা দেশের শহরগুলোর মধ্যেও বেশ আলাদা হয়ে থাকে, গ্রামগঞ্জের স্কুল-মাদ্রাসাগুলোর অবস্থা বরাবরই পিছিয়ে পড়াদের তালিকায় থাকে। এ বছরও গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাসের হারে পিছিয়ে পড়ার বাস্তবতা লক্ষ্যণীয় বিষয় হয়ে আছে। অন্য যে বিষয়টি বেশ উল্লেখ করার মতো তা হচ্ছেÑ এ বছরও একটি শিক্ষা বোর্ড ভীষণভাবে এগিয়ে, অন্য একটি শিক্ষা বোর্ডকে অবিশ্বাস্যভাবে পিছিয়ে পড়তে দেখা গেছে। এটিও প্রতি বছরের মূল চিত্রের সঙ্গে এ বছরও মিল রয়েছে। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হারে ৬০ শতাংশের নিচে, অথচ রাজশাহী বোর্ডে ৯০ শতাংশের বেশি।
এমন বৈপরীত্যই বলে দেয় আমাদের পাবলিক পরীক্ষার মধ্যে বড় ধরনের গলদ রয়েছে। এই গলদের কুফলই শিক্ষার্থীদের ভোগ করতে হচ্ছে। অন্যান্য বছরও প্রায় একই চিত্র বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের বেলায় ঘটে থাকে। মনে হচ্ছে শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা রয়েছে পাসের হার বাড়ানো বা কমানো নিয়ে। আসলে আমরা দীর্ঘদিন থেকে একটি ভুল আলেয়ার পেছনে দৌড়াচ্ছি। শিক্ষা নিয়ে আলেয়ার লুকোচুরির ফাঁদে পা দেওয়ার ক্ষতি সম্পর্কে আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত সচেতন না হব, এর পরিণতি সম্পর্কে না বুঝতে পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত জাতির ক্ষতি বই লাভ কিছুই হবে না। শিক্ষা বোর্ডের ধারণা পৃথিবীতে এখন অচল, অথচ আমরা বোর্ডের পর বোর্ডের জন্ম দিচ্ছি। বোর্ডগুলো পরীক্ষার আয়োজন করে থাকে। কিন্তু মূল লেখাপড়ার দায়িত্ব শিক্ষা বোর্ডগুলোর বিন্দুমাত্রও নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনো পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পঠনপাঠনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়ার কোনো গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি, নিয়ম, আইন-কানুন, বিধি-বিধান, তথা পঠনপাঠনের সংস্কৃতির কোনোটিই চালু করতে পারেনি।
বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই চলছে পঠনপাঠন বা মানসম্মত পাঠদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার বাইরে। নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, বিদ্যাশিক্ষাহীনতা এগুলোতে বাসা বেঁধেছে। ফলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই মানসম্মত শিক্ষালাভের সুযোগ পাচ্ছে না, সেদিকে কারও কোনো দৃষ্টি নেই। সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে পাবলিক পরীক্ষায় কিভাবে জিপিএ ৫ পাওয়া যাবে। এর জন্য সস্তা ও সোজা উপায় হচ্ছে কোচিং করা, গাইড বই ইত্যাদি নির্ভর লেখাপড়া ও পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া। বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানার বিষয়টি গৌণ হয়ে গেছে। অথচ পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র গতানুগতিক, মূল্যায়ন হয় তাড়াহুড়া এবং মানহীনতার মধ্যদিয়ে। এর কোনোটিই শিক্ষার্থীর জ্ঞানার্জনকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারে না। সে কারণেই পাবলিক পরীক্ষা পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে বসেছে শিক্ষকদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীর জ্ঞানার্জনকে যাচাই করা হচ্ছে। আমরা আরও বেশি জড়িয়ে পড়ছি। আসলে করণীয় কাজ হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়া, পাঠদান করা, মূল্যায়ন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের প্রথম থেকে তৈরি করতে হয় এবং মূল্যায়ন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের প্রথম থেকেই গড়ে তুলতে হয়। তবেই শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা লাভের মাধ্যমে সফল মানুষ রূপে গড়ে উঠতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়