পিঙ্কের সাথে মিল থাকলেও পরিণতি একই হবে না যায়নুদ্দিন সানী
ধর্ষণের সিজন শুরু হয়েছে। প্রথমে সেই পিতা-কন্যার আত্মহত্যা, এরপরে ঠাকুরগাঁ আর সবশেষে এই বনানী। প্রথম দুটোর তেমন বাজার দর না থাকলেও বনানীর ঘটনায় পত্রিকার কাটতি খারাপ হচ্ছে না। কমবেশি সবাই-ই শিরোনাম করেছেন। প্রথম পাতায়ও রেখেছেন। তারপরও পাঠক টানতে শুরু হয়ে গেছে মুখরোচক রিপোর্টিং। সঙ্গে থাকছে সেক্সি হেডলাইন। চেষ্টা থাকছে কে নতুন কিছু যোগ করতে পারেন। এতসব ঘটনার ভেতর পিতা-কন্যা বহু আগেই ইতিহাস হয়েছেন। উনাদের মতো গরিবদের আপাতত কোনো খাওয়া নাই। ঠাকুরগাঁওয়ের যদিও সম্ভাবনা ছিল, তবে বনানী ঝড়ে সেটাও সম্ভবত পেছনের পাতায় যাব যাব করছে।
সবদিক বিবেচনায় নিলে, ধর্ষণ সিরিজের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এপিসোড হচ্ছে বনানী অ্যান্ড ইট ইজ অ্যান ইনস্ট্যান্ট হিট। শুধু হিট বললে ভুল হবে, সুপার হিট। কাহিনী উঁচু তলার মানুষ নিয়ে, সঙ্গে আছে সেক্স, মদ, ফ্রেন্ডশিপ, ধোঁকা, স্ক্যান্ডাল, আর কি চাই। তার ওপর কাহিনীর সাথে যেহেতু ভারতীয় সিনেমা ‘পিঙ্কে’র মিল আছে, পাব্লিক আরও মজা নিয়ে পড়ছে। ‘এক্কেবারে সিনেমার কাহিনী’।
পত্রিকার কাজ যেমন পত্রিকা করছে, ফেসবুকও তেমনি যথারীতি কমবেশি সরগরম। যে যেভাবে পারছে স্ট্যাটাস বর্ষাচ্ছে। কথাবার্তায় অবশ্য তেমন নতুনত্ব নেই, সেই উপদেশ বাণী ‘নারীর প্রতি সম্মান দেখাতে শিখুন’। কেউ কেউ আবার পিঙ্ক সিনেমার সেই ডায়ালগ কপচাচ্ছে, ‘নো মানে নো’। কিছু কিছু আঁতেল তো থাকেই, উনারা সমাজের অবক্ষয়ের কারণ অনুসন্ধানে নেমে পড়েছেন। কেউ আওয়ামী সরকারকে দুষছেন আবার কেউ এটাকে দলীয় রাজনীতির বাইরে রাখতে বিবেককে উস্কে দেওয়া টাইপ বাণী ঝাড়ছেন। কেউ কেউ আমার মতো দুকলম লিখে পত্রিকায় পাঠাচ্ছেন। যদিও সবাই জানি কিসসু হবে না, তারপরও করছি। আসলে অভ্যাস তো, তাই না লিখে পারা যায় না।
ওদিকে ফেসবুকে যথারীতি স্ট্যাটাসের পর স্ট্যাটাস পড়ছে। ফেসবুকে যারা অ্যাক্টিভ, তাদের জন্য এমন সব পরিস্থিতিতে একটা স্ট্যাটাস দেওয়া ফরজ। বিশেষ করে তিনি যদি সেলিব্রেটি কোনো ফেসবুকার হন। ওই, নিজেকে বিবেকবান প্রমাণ করা আর কি। কমবেশি সবাই দু-একলাইন বাণী দিচ্ছে। কেউ ‘বিচার চাই’ মার্কা সেই পুরনো ডায়ালগ। কেউ আবার ‘জাতিকে জাগতে হবে’ কিংবা ‘আসুন প্রতিরোধ গড়ে তুলি’ টাইপ বিপ্লব বিপ্লব ডায়ালগ। যদিও এ সবে কমবেশ আমরা সবাই অভ্যস্থ, পুরনো প্রতিটা রেপের পরেই এমনটা হয়, তারপরও খারাপ লাগছে না। অ্যাট লিস্ট টাইম পাস হচ্ছে।
এনিওয়ে, বনানীর কারণে মনে হচ্ছে ঠাকুরগাঁওয়ের সেই ইমাম সম্ভবত পার পেয়ে যাচ্ছেন। অ্যাট লিস্ট শিরোনামে থাকবেন বলে মনে হয় না। বাকিটা তার পাব্লিক লিয়াজোঁ। যেহেতু ধর্মের সাথে যুক্ত একজন ব্যক্তিত্ব, তাই নাস্তিক বাহিনী আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, ওটাও যেন লাইম লাইটে থাকে। ওই শিশু তাদের কনসার্ন না, আসলে তাদের উদ্দেশ্য এই বাহানায় ধর্মকে এক হাত নেওয়া। সফল হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। যেহেতু দারিদ্র্যে তেমন কোনো গ্ল্যামার নেই, তাই আপাতত ঠাকুরগাঁও হিট করানো রিয়েলি টাফ। সঙ্গে যদি বনানীর মতো সেক্সি একটা ঘটনা পাশে থাকে, তাহলে শিরোনাম রেসে জেতা প্রায় অসম্ভব। আই থিঙ্ক উই ক্যান সে গুড বাই টু ঠাকুরগাঁও।
সো? কি ভাবছেন? কিছু হবে? পিঙ্কের ফিনিসিং পাওয়া যাবে? কিংবা অ্যাট অল ধর্ষকদের দেখা পাওয়া যাবে? মজাটা এখানেই। কিছু যে হবে না, তা কমবেশি আমরা সবাই জানি। কেন হবে না, তাও জানি। তারপরও এই বিপ্লব বিপ্লব খেলায় আমরা সবাই সামিল হচ্ছি। কেন? বোধহয় এক্সাইটমেন্ট। এই বিবেক সাজবার প্রচেষ্টায় কোথায় যেন একটা উত্তেজনা আছে। তবে এই উত্তেজনা আবার বেশিদিন আমাদের ভাল লাগে না। সেটা পুলিশ থেকে শুরু করে ধর্ষক এবং এক্ষেত্রে ওনার সুযোগ্য পিতাও ব্যাপারটা জানেন। এখন ঠিক সেটাই চলছে, কালক্ষেপণ।
একটা কথা কি ভেবে দেখেছেন, দোষীর শাস্তি হচ্ছে কি না, তা জানবার ইচ্ছে কিন্তু আমাদের এই মুহূর্তে নেই। আপাতত প্রথম ইচ্ছে হচ্ছে, ঘটনার একটা রগরগে বর্ণনা চাই। যারা সেই ধর্ষিতার কাছে যাচ্ছেন, ইনিয়ে বিনিয়ে সেটাই জানতে চাইছেন, ‘তারপরে কি হলো।’ এখনো কোনো পত্রিকায় সেটা আসেনি তবে আমার ধারণা অচিরেই আসবে। কোন পত্রিকা প্রথমে সেটা জানাবে, বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু যে আনবে, সমালোচনার মুখে পড়লেও সে দান মেরে দিবে। সেদিনের পত্রিকা বিক্রি সীমা ছাড়াবে।
এই ঘটনার আরও কিছু ব্যাপারও আমাদের আকর্ষণের কেন্দ্রে আছে। এই ধর্ষক বাহিনীর পুরনো কীর্তি-কলাপের ফিরিস্তি, গুলশান বনানী এলাকায় এমন ঘটনা আরও ঘটেছে কি না। এসব নিয়েও কিছু রিসার্চ হবে মনে হচ্ছে। কেউ কেউ তো থাকেনই, পুলিশের অকর্মণ্যতা, এদেশের আইনের ফাঁক-ফোকর, এসব নিয়ে। কেউ খুঁজছেন পিতার ক্ষমতার দৌড়। আপন জুয়েলার্স বর্জন থেকে শুরু করে সেই নারীদের দোষ খোঁজা, গতানুগতিক সব কার্যকলাপও যথারীতি চলছে।
তো? কি মনে হয়? শেষ কি হবে? পিঙ্ক সিনেমার মতো? দারুণ ঝানু এক উকিল সেই নারীদের হয়ে কেস লড়তে রাজি হবেন? সমস্ত ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে অবশেষে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করে দিবেন? না হঠাৎ আবিষ্কার হবে এটা ষড়যন্ত্র? সেদিন আসলে যা ঘটেছে তা ঘটেছে মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে?
তেমন কিছুই হবে না। অ্যাট লিস্ট ইতিহাস তাই বলে। যা হবে তা হচ্ছে আরেকটা মজাদার খবরের আমদানি হবে আর পুরনো খবর পিতা-কন্যার আত্মহত্যার মতো ভুলে যাব। তারপরও কেন এত উৎসাহে এসব খবর পড়ছি? মজা এখানেই। যদিও জানি পিঙ্ক সিনেমার মতো তেমন কিছু হবে না, তারপরও কেন দেখছি এই সিনেমা? দেখছি কারণ মজা পাচ্ছি।
সিনেমা একটি নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে হয় আর দর্শকের মনোরঞ্জন করতে হয়। তাই ওখানে কেসের শুনানিও দ্রুত হয় আর রায়ও দ্রুত হয়। বাস্তব জীবনে? কাম অন ম্যান, এটাও বলে দিতে হবে?
লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট