বেইজিংয়ে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে
মেসবাহ উল্লাহ শিমুল : রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের চাপ বাড়ছে। জাতিসংঘ, ইসলামী সম্মেলন সংস্থা-ওআইসি, সার্কসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সরকারকে সহায়তারও প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। যদিও এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের পক্ষ থেকে নমনীয়তার আভাস পাওয়া যায়নি। এছাড়া আজ এবং আগামীকাল চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে বৈশ্বিক যোগাযোগ করে ২৮ দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারেও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিয়েও আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। এ সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, রাশিয়া, জাপান দক্ষিণ কোরিয়াসহ প্রভাবশালী দেশগুলো অংশগ্রহণ করবে।
সূত্র মতে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়নে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান সম্প্রতি বাংলাদেশে পাড়ি জমায়। যদিও তিন দশক ধরে আরো অন্তত তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছেন। এ অবস্থায় অতিরিক্ত রোহিঙ্গাদের চাপ সামলাতে সীমান্তে কঠোরতার নীতি অবলম্বন করে সরকার। এরপরই বিশ্বজুড়ে আলোচনায় উঠে আসে রোহিঙ্গ ইস্যু। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে অসংখ্যবার অনুরোধ জানালেও দেশটির পক্ষ থেকে আশানুরুপ সাড়া না পাওয়ায় আন্তর্জাতিক মহলের শরণাপন্ন হয় সরকার। এরই জের ধরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব থেকে শক্তিশালী দেশ চীনের সহায়তা চাওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। সরকারের সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে চীনও এ সমস্যার সমাধানে আশ্বাস দিয়েছে। গত দু’সপ্তাহের মধ্যে দুইটি চীনা প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরকালে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনাও হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত সান গোশিয়াং ও দেশটির ইউনান প্রদেশের প্রাদেশিক সরকারের সিনিয়র উপদেষ্টা লি ঝিউলিং গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকা সফর করেন। সর্বশেষ গত সপ্তাহে ঢাকায় সিনিয়র উপদেষ্টা লি ঝিউলিংয়ের সঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের এক বৈঠক হয়। বৈঠকে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানে চীনের সহায়তা চান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। সে সময় চীনা উপদেষ্টা এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে চীন সহযোগিতা দেবে বলেও আশ্বাস দেন চীনা উপদেষ্টা। বৈঠকে রোহিঙ্গা সমস্যা ছাড়াও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৈষম্য দূর করতে চীনের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য ১৭টি পণ্যের শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য চীনকে অনুরোধ করা হয়।
এর আগে গত ২৩-২৬ এপ্রিল ঢাকা সফর করেন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত সান গোশিয়াং। সে সময় পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের সঙ্গে এক বৈঠক হয়। সে সময় পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বিশেষ করে গত ৯ অক্টোবরের পর থেকে বাংলাদেশে আরো ৭০ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। তার আগে থেকেই বাংলাদেশে আরো তিন লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। রোহিঙ্গারা নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে বলে চীনের বিশেষ দূতকে অবহিত করা হয়। এছাড়া রোহিঙ্গাদের সার্বিক পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখার উদ্দেশ্যে কক্সবাজারে যাওয়ার জন্যও বিশেষ দূতকে অনুরোধ করা হয়। এ প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের প্রতিবেশি ও প্রভাবশালী দেশ হিসেবে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে চীনের সহযোগিতা চাওয়া হয়। চীনের বিশেষ দূত সান গোশিয়াং রোহিঙ্গা সঙ্কট সমধানে তার দেশ সহযোগিতা দেবে বলে আশ্বাস দেন।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সঙ্কট সমস্যা সমাধানে অনেক আগেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা করেছে। বাংলাদেশের আহ্বানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সাড়াও দিয়েছে। বিশেষ করে জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে মিয়ানমারের ওপর চীনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীনের ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশা করে আসছে বাংলাদেশ। কেননা ঢাকা-বেইজিংয়ের মধ্যে এখন উচ্চতর সম্পর্ক বিরাজ করছে। সে কারণে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে চীনের সহযোগিতা নিতে চায় বাংলাদেশ। চীনের বিশেষ দূতের ঢাকা সফরের মধ্যদিয়ে এই সহযোগিতার নতুন পথ ধীরে ধীরে খুলবে বলে প্রত্যাশা করছে সরকার। বৃহস্পতিবার দেশটির ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত মায়ো মিন্ট থান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবারো দেশটির রোহিঙ্গা নাগরিকদের সে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেন। এসময় রাষ্ট্রদূত থান দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অং সান সুচিসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে এ বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেন রাষ্ট্রদূত থান।
পররাষ্ট্র ও বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আজ ও আগামীকাল চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড শীর্ষক এক সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, জাপানসহ মোট ২৪টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করছেন। চীনের আমন্ত্রণে এ সম্মেলনে বাংলাদেশের সাতজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী অংশ নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে তারা সম্মেলনে অংশ নিতে বেইজিং পৌঁছেছেন। সম্মেলনের ফাঁকে সাইড লাইন বৈঠকে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়েও চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হতে পারে বলেও জানান এ দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
এর আগে, মিয়ানমার সীমান্তে নতুন করে রোহিঙ্গা সঙ্কট তৈরির পর পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গত ১০ জানুয়ারি দেশটির বিশেষ দূত ইউ কিও তিন ঢাকা সফর করেন। তার ওই সফরের পর গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ঢাকায় আসেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি। বাংলাদেশ সফর শেষে নিউইয়র্কে ফিরে গিয়ে জাতিসংঘে পেশ করা এক প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নির্মূল করতে চায়। এ বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা নেয়ার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান এ বিশেষ দূত।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের পুলিশ ফাঁড়িতে হামলায় ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর থেকে রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর চরম নিপীড়ন শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। জীবন বাঁচাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। ৯ অক্টোবরের পর থেকে বাংলাদেশে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করে। আর বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ৩০ হাজার শরণার্থী রয়েছেন। এর আগে থেকেই আরো তিন লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কক্সবাজার থেকে সরিয়ে নিয়ে হাতিয়া উপজেলার ঠেঙ্গারচরে আশ্রয় দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।